বাঙলী স্বর্গে গেলেও মাছ খাবে। তাও কোনো বিদেশী মাছ না, একেবারে খাঁটি দেশী মাছ। এটা অভিশাপ নাকি আশীর্বাদ – সেটা নিয়ে তর্ক-বিতর্ক করার প্রচুর রসদ পাওয়া যেতে পারে। কিন্তু বাঙালীর মাছ খাওয়ার বাড়াবাড়ি দেখে আশ্চর্য হবার কিছু নাই।
চীন, জাপান, বার্মা, পূর্ব-দক্ষিণ এশিয়ার দেশ ও দ্বীপপুঞ্জ, প্রশান্ত মহাসাগরীয় দ্বীপপুঞ্জের অধিবাসীদের প্রধান খাদ্যাতালিকায় আছে ভাত-মাছ। বাঙালীদেরও তাই। বাঙলার অজস্র খাল-বিল, নদী-নালায় এত মাছের ছড়াছড়ি দেখেও মাছ না খাওয়ার লোভ বাঙলী কোনোকালেই ছাড়তে পারেনি, বরং দিন দিন বেড়েছে। এই মৎস্যপ্রীতিই সভ্যতা ও সংস্কৃতিই দিক দিয়ে অন্যান্য ভারতীয়দের কাছে থেকে আলাদা করে রেখেছে। ভারতের আর্যসভ্যতা ও সংস্কৃতি বাঙালীদের এই মৎস্যপ্রীতি কোনোদিনই ভালো চোখে দেখে নাই। আজও বাঙালীদের এই মাছ খাওয়া দেখে অনেকে নাক ছিঁটকায়। কিন্তু তাতে কি! ভাত-মাছই বাঙালীদের প্রাণ, সেই ১৯৫৩ সালের আগে থেকেই!
প্রায় আড়াই বছরের আগে থেকেই ভারতের আর্য-ব্রাহ্মণ্যধর্মে (বৌদ্ধ, জৈন সহ) খাওয়ার জন্য প্রাণীহত্যার প্রতি একটা নৈতিক আপত্তি প্রকাশ পাচ্ছিল। সেই থেকে তারা নিরামিষ ভোজের প্রতিই পক্ষপাতী হয়ে উঠেছিল। (পৃথিবীর অন্যান্য জতিদের চেয়ে ভারতীয়দের পাতলা-চিকনা শারীরিক গঠনের এটা একটা প্রধান কারণ কিনা সেটাও একটা তর্কের বিষয় হতে পারে।) প্রানীহত্যার প্রতি আপত্তি বাঙলাতেও উঠেছিল। কিন্তু দেখা যাচ্ছে সেটা কোনোদিনই তেমন পাত্তা পায় নি। কোনো শক্তিই চিরাচরিত ও বহু দিনের অভ্যস্ত প্রথা এত সহজে ভাঙতে পারে না।
বাঙলার অন্যতম প্রথম ও প্রধান স্মৃতিকার ভবদেব ভট্ট। তিনিও অনেক যুক্তিতর্ক দিয়ে বাঙালীদের অভ্যাসকেই সমর্থন করেছিলেন। তিনিই অনেক শাস্ত্র ঘেঁটে প্রমাণ দেখিয়েছিলেন যে মাছ-মাংস খাওয়ায় কোনো দোষ হয় না। কিছু তিথি ও বিশেষ বিশেষ অনুষ্টানে না খেলেই হলো। অনেকে বলেন বাঙালীর চিরাচরিত অভ্যাসকে সমর্থন না জানিয়ে তার কোনো উপায় ছিল না। প্রাণীজ ও উদ্ভিজ্জ তেল বা চর্বির তালিকায় জীমূতবাহন ইলিশ মাছের কথা উল্লেখ করেছেন। বাঙালীর আরেক স্মৃতিকার শ্রীনাথাচার্যও এই মত সমর্থন করেন। বৃহর্দ্ধমপুরাণেও আছে যে সাদা ও আঁশযুক্ত মাছ ব্রাহ্মণেরাও খেতে পারেন। কিন্তু যে মাছ গর্তে বা কাঁদায় বাস করে, মুখ ও মাথা সাপের মত (যেমন, বাণ মাছ), দেখতে কদাকৃতি, আঁশহীন, পচা, শুকনো মাছ ব্রাহ্মণদের পক্ষে নিষিদ্ধ ছিল। এছাড়াও শামুক, কাঁকড়া, মোরগ, সারস, বক, হাঁস, পাখী, উট, গরু, শূকর – এসব নিষিদ্ধ ছিল। তবে নিম্নতর সমাজে এসব কেউ মানত না। (সমাজে স্তর বিন্যাসে এটাও একটা কারণ কি?)
বাঙালীদের মৎস্যপ্রীতির পরিচয় ময়নামতি ও পাহাড়পুরের পোড়ামাটির ফলকগুলোতে পাওয়া যায়। সেখানে মাছ কোটা বা ঝুড়িতে ভরে হাটে নিয়ে যাওয়ার চিত্র আছে। হরিণ শিকার করে নিয়ে যাওয়ার চিত্রও আছে। এর বর্ণনা পাওয়া যায় চর্যাগীতেও।
মাছ খাওয়ার এমন ঐতিয্য পৃথিবীতে আর কোন জাতির আছে বলে জানা নেই। সেই বাঙালী দেশের বাইরে গেলেও মাছ দুদিন পরে মাছ খুঁজবে – সেটাই স্বাভাবিক।
আমার আগের জেনারেশন নিউইয়র্কে এসেছেন প্রায় দুই যুগ। তখনো দেশী দোকানপাটই ছিলো না দু-চারটে হাতেগোনা ছাড়া। দেশ থেকে মাছ বা অন্যান্য কিছু আসারও তেমন চালু হয়নি। ভরসা ছিল চাইনীজ মার্কেট। সেখানে নাকি কিছু কিছু পাওয়া যেত তবে সে স্বাদ দেশী স্বাদ থেকে যোজন যোজন দূর।
আমার জেনেরেশনের শুরু প্রায় এক যুগ আগে। এর পর ডিভির কল্যানে বাঙালীদের জোয়ার বইতে শুরু করল। এসে দেখতে শুরু করলাম পুরোনো দোকানগুলো উঠে যাচ্ছে বা হাত বদল হয়ে দিন দিন বড় হচ্ছে। নিউইয়র্কের জ্যাকশন হাইটস থেকে ইণ্ডিয়া-পাকিদের একপ্রকার বিতাড়িত করে অনেকদিন হয়ে গেল সেটা একটা লিটল বাংলাদেশ ঘোষণার দাবী উঠছে। দেখতে দেখতে অনেক বাঙলী ব্যবসায়ীদের দেহের দৈর্ঘ্যে না বাড়লেও প্রস্থ ও বেধে চতুর্দিক থেকে বাড়তে শুরু করল। অনেকের পাছা এতটাই গরম যে – কাহিনীটা বলছি –
সাধারণ জীবন-যাপনের ফলে ব্যক্তিগর ভাবে নিজেকে খুব সুখী মনে হয় (কোনো অহংকারের কথা নয়)। সারা সপ্তাহ কাজ করে ছুটির দিনগুলোতেও অনেক লণ্ড্রী করা থেকে শুরু করেন অনেক ব্যক্তিগত কাজ থাকে। যান্ত্রিকতার ধরাবাঁধা নিয়মে সবই চলে যাচ্ছে যন্ত্রের মত। তবে মাঝে মাঝে উলটো হাওয়াও বয়। তেমনি একটা কাজ হলো – বাজার করা। দু-তিন সপ্তাহ পর পর এই ঝামেলা এসে হাজির হয়! বাবা থাকলে তিনিই যান। কিন্তু গাড়িটা নিয়ে হয় আমাকে নয়তো ছোটো ভাইটাকে যেতে হয়। এই কাজের ভারটা ছলে-বলে-কৌশলে যতটা পারি ছোটো ভাইয়ের উপর চাপিয়ে দেই। কেননা জ্যাকসন হাইটে এত্ত লোকজনের কোলাহল আর পার্কিং করার সমস্যা! আমার ‘সুখী’ জীবনের সাথে ঠিক মানায় না।
বাবা দেশে গেলে মা মাঝে মাঝে থেকে যান হসপিতালের চেক-আপের ঝামেলায় পড়ে। তখন মা-ই যান বাজার করতে। মা’র মতে শুধু আমি আর ছোটো ভাই গেলে জিনিসপত্র নাকি “টাটকা” থাকে না। কিছুদিন আগে মা মাছ কিনে এনেছেন অনেক। ফ্রোজেন মাছ। দেশ থেকে আসে। দুদিন পর ধরা খেয়েছেন; মাছ ক্লিন করতে গিয়ে দেখেন অর্ধেক পচা। দেখলাম মাছের প্যাকেটে মেয়াদের তারিখের কোনো ঠিক-ঠিকানা নেই। তারিখ একটা ছিলো বটে, তবে তার উপর আবার মার্কার দিয়ে অন্য একটা তারিখ হাতে লেখা। দু-তিন বার এরকম হলে একদিন বললাম দোকানে কল দাও। কল দিয়ে আমাকে ধরিয়ে দিলেন। সমস্যার কথা বললাম। উত্তর শুনে আমি ‘থ’। বলে – রান্না করে খেয়ে ফেলেন, কোনো সমস্যা হবে না। সবাইতো এই মাছই খায়!
বুঝলাম এদের দোষ দিয়ে লাভ নেই। এরা তো মাছ আমদানী করে না। এবার যারা করে, প্যাকেটের গায়ে তাদের নাম ফোন নাম্বার দেখে তাদেরকে কল দিলাম। শুরু হলো ধানাই-পানাই। কবে কিনেছেন। মেয়াদের তারিখ কত ছিলো। দোকানে কল দিয়েছেন কিনা। দোকানে নিয়ে যান, বদলে আনেন। হেন তেন। কিন্তু মেয়াদের তারিখ দিয়ে আসলেই কিছু বুঝানো হয় কিনা তার উত্তর পেলাম না। ভাবলাম এইসব খাবার তাহলে এদেশে ঢোকার অনুমতি পায় কি করে!
বুঝলাম মেয়াদ নিয়ে বাঙলীদের কোনো সমস্যা নেই। পচা হোক আর তাজা হোক, মাছ পাওয়া যাচ্ছে – এটাই ভাগ্যের ব্যাপার! মা’কে বললাম মাছ খাওয়া বন্ধ। তা কি হয়! বলে এর পর থেকে কেনার সময় ভালো করে দেখে আনবে। কিন্তু দু-তিন সপ্তাহের জন্যে কেনা অনেক মাছের মধ্যে প্রায়ই দু-চার প্যাকেট খাওয়ার অযোগ্য থেকেই যাচ্ছে! সমাধানের কোনো পথ খুঁজে পেলাম না। এখনো নাই মামার চেয়ে কানামামাই ভালোর ব্যবস্থা চলে যাচ্ছে। বিড়াল পর্যন্ত মাছ না খেয়ে থাকতে পারবে কিন্তু বাঙলী? ভরসা নেই।
——————
১১ জুলাই ২০১০