ছোট-বড় ২৪০ টি হাওর বিলের সমন্বয়ে জীব-বৈচিত্রে ভরপুর হাকালুকি হাওরের অবস্থান। কালের পরিক্রমায় সেই বিলগুলো অনেকটা কমে গেছে। দেশের পূর্বাঞ্চলে অবস্থিত এশিয়ার বৃহত্তর ও দেশের সবচেয়ে বড় হাওর হাকালুকি আজ ধ্বংসের একেবারে দোরগোড়ায়। সুষ্ঠ ব্যবস্থাপনার অভাব ও স্থানীয়দের ধ্বংসযজ্ঞের কারণে জীব বৈচিত্র ভরপুর বিশ্বখ্যাত হাকালুকি হাওর থেকে জীব বৈচিত্রের সবটুকু চিহ্ন আজ বিলীন হতে চলেছে। হাজারো সমস্যার অন্তরালে বেঁচে থাকা এ হাওরের ভবিষ্যত কতখানি উজ্জল তা নিয়ে পরিবেশবীদরা অনেকটা উদ্বিগ্ন। উৎকন্ঠায় আছেন প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষভাবে নির্ভরশীল হাওরাঞ্চলের বাসিন্দারা।
সরকারী হিসাবে ১ হাজার ২০৩ প্রজাতির উদ্ভিদ ও প্রাণীর এই হাওর এখন অনেকটাই উদ্ভিদ শূন্য হয়ে পড়েছে। নানা সময় সরকার এই হাওরের অস্তিত্ব বাঁচিয়ে রাখার স্বার্থে নানামুখি পদক্ষেপ নিলেও তাতে কোন কাজ হয়নি। অপরদিকে অদূর ভবিষ্যতে এ হাওরের অস্তিত্ব টিকিয়ে রাখতে সরকার কি প্রদক্ষেপ গ্রহন করবে সেটি এখন দেখার বিষয়। ইতিমধ্যে এসব কারণে সরকার হাকালুকি হাওরকে পরিবেশগত সংকটাপন্ন এলাকা বা ইসিএ হিসাবে ঘোষনা করেছে।
এই হাওরে এক সময় ছোট-বড় ২৪০ টি বিল থাকলে ও এখন বিলে সংখ্যা কমে এসেছে। কোন কোন বিল এখন কেবল নামে মাত্র বিল হিসাবে চিহিৃত। সেখানে গড়ে উঠেছে বসত বাড়ী। তবে সম্প্রতি সরকারের পরিবেশ অধিদপ্তর থেকে হাওর রক্ষা ও জীববৈচিত্র্য সংরক্ষণের স্বার্থে ‘উপকূলীয় জলাভূমি জীববৈচিত্র ব্যবস্থাপনা প্রকল্প’ নামে একটি প্রকল্প গ্রহন করেছে। প্রকল্পকে কাগজে কলমে সীমাবন্ধ না রেখে প্রকল্পের যথাযথ বাস্তবায়নের উপর গুরুত্বরোপ করার অভিমত ব্যক্ত করেছেন পরিবেশবীদরা।
ঐতিহ্যবাহী হাকালুকি হাওর সিলেট বিভাগের সিলেট ও মৌলভীবাজার জেলাসহ ৫টি উপজেলা নিয়ে বি¯ৃ—ত। এই হাওরকে কেন্দ্র করে প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে এ অঞ্চলের অন্তত ৪ লক্ষাধিক মানুষের জীবন জীবিকা নির্ভর করছে। একদিকে সিলেটের গোলাপগঞ্জ উপজেলার উত্তর ভাদেশ্বর ও শরিফগঞ্জ ও ফেঞ্চুগঞ্জের গিলাছড়া, অপরদিকে মৌলভীবাজারের কুলাউড়ার, ভাটেরা, বরমচাল, ও ভূকশিমইল, জুড়ি, পশ্চিমজুড়ি, জাফর নগর এবং বড়লেখা উপজেলার দক্ষিণভাগ সুজানগর, বর্ণী ও তালিমপুরের বৃহদাংশ জুড়ে এর অবস্থান। এক পরিসংখ্যানে দেখা গেছে, হাওরটি মৌলভীবাজার জেলার শতকরা ৭৫% এবং বাকি ২৫% সিলেট জেলায়। হাওর এলাকায় মোট ইউনিয়নের সংখ্যা ১১টি এবং গ্রাম রয়েছে ২৫৩ টি। এ দুটি জেলার মোট ৩৯ হাজার ৩২৩ হেক্টর নিয়ে হাকালুকি হাওরের অবস্থান। এখানে শতকরা ৬৩ ভাগ জলরাশি। আর বাকি ৩৭ ভাগ এলাকা বসত বাড়ি, চা বাগান, পাহাড় ও তুলনামূলক উচুঁ ভুমি। তবে বর্ষা কালে হাওরের জলরাশির মোট আয়তন এসে দাঁড়ায় ২৪ হাজার ৭’শ হেক্টর । সরকারি হিসাবে হাকালুকি হাওরের মাঝ দিয়ে ছোট বড় বেশ কয়েকটি নদী বয়ে গেছে। বর্তমানে এশিয়া মহদেশের সবচেয়ে বড় মিঠা পানির হাওর হিসেবে চিহ্নিত হাকালুকি হাওর। এ হাওরে বিরল প্রজাতির জলজ প্রাণী ও উদ্ভিদ রয়েছে। পরিবেশ অধিদপ্তরের তথ্য মতে, বাংলাদেশের অসংখ্য জলজ প্রজাতির উদ্ভিদ আছে এ হাওরে। এর মধ্যে হিজল, করচ, বরুন, আড়ং ও মাখনা অন্যতম। এগুলোর কারণে পর্যটকদের জন্য হাকালুকি হাওড় শুকনো মৌসুমে সবুজের অরণ্যে পরিণত হয়। আর বর্ষা মৌসুমে চার দিকে থৈ থৈ জলরাশির কারণে পর্যটকদের মনের মধ্যে এক অনাবিল আনন্দে ছোঁয়া শিহরণ দিয়ে যায়। এই হাওড়ে ১১২ প্রজাতির হিসেবে মদনটাক, প্যালাসেস ফিস ঈগল উল্লেখযোগ্য। যা এখন বিশ্বের আর কোথাও দেখা যায় না। এছাড়া এই হাওরে রয়েছে ১২ প্রজাতির উভচর প্রাণী, ৭০ প্রজাতির সরীসৃপ, ৬৯ প্রজাতির স্তন্যপায়ি প্রাণী।
যা দেশ থেকে আজ খুব দ্রুত বিলুপ্তি হয়ে যাচ্ছে। বিলুপ্ত প্রায় এই প্রাণীগুলোর মধ্যে রয়েছে উদবিরল, মেছোবাঘ,বাগড়াশসহ আরো কয়েকটি । এখানকার নদীগুলোতে এখনও মাঝে মধ্যে জলজ শুকুরের দেখা পাওয়া যায়।এছাড়া হাকালুকি হাওরে এক সময়ে ১০৭প্রজাতির মাছ ছিল।তার মধ্যে এ পর্যন্ত ঠিকে আছে ৭৫প্রজাতির মাছ আর বিলুপ্তির পথে রয়েছে ৩২ প্রজাতির মাছ। এখনো হাকালুকি হাওরে জালে ধরা দেয় বিরল প্রজাতির মধূ পাবদা , কালিবাউস , রানি , বাঘাগুতুম, মেনি ও কাকিলা মাছ।
সরজমিনে পরিদর্শণকালে মৎস্যজীবি আব্দুর রহিম, কুরুস মিয়া, আব্দুল হাই, রাজা মিয়া, সালাউদ্দিন, কেরামত মিয়া, ফজলুল হক, সোহেল মিয়া, জব্বার মিয়া জানান, হাকালুকি হাওরের উপর প্রায় লক্ষাধিক মানুষ নির্ভরশীল। এসব মৎস্যজীবি কর্তৃক আহোরিত মাছ ও অন্যান্য জলজ খাদ্য বিক্রি হয় বৃহত্তর সিলেটসহ দেশের নানা প্রান্তে। কিন্তু বর্তমানে হাওরের আগের সেই অবস্থান নেই।
অপরিকল্পিতভাবে মৎস আহরণ, হাওরের বিভিন্ন স্থানে বাঁধ দিয়ে মাছ চলাচলে ব্যঘাত সৃষ্টি, হাওরের চর্তুপাশে কৃষি জমিতে মাত্রাতিরিক্ত রাসায়নিক সার ও কীটনাশক প্রয়োগ ইত্যাদি কারণে হাওর তার অস্তিত্ব হারিয়ে বসতে চলেছে। তারা মনে করেন সরকার এ হাওরের প্রতি একটু আন্তরিক হলে এ হাওর থেকেই কোটি কোটি টাকা রাজস্ব আয় সম্ভব। তারা এ ব্যাপারে দ্রুত সরকারি হস্তক্ষেপ কামনা করেন।