বাংলাদেশের বৃহত্তম একমাত্র প্রাকৃতিক জলপ্রপাত মাধবকুন্ড ইকোপার্ক, নয়নাভিরাম দৃশ্য ও নান্দনিক পিকনিক স্পট হিসাবে দেশী বিদেশী পর্যটকদের সুপরিচিত। সুবিশাল পর্বত গিড়ি, শ্যামল সবুজ বনরাজি বেষ্টিত ইকোপার্কে প্রবীন,নবীন,নারী-পুরুষদের উচ্ছাস অট্টহাসি আর পাহাড়ী ঝরনার প্রবাহিত জলরাশির কল কল শব্দ স্বর্গীয় ইমেজের সৃষ্টি করে। তাছাড়া বিভিন্ন প্রজাতির পাখী, বন্য বানর,ও কীট পতঙ্গের অচেনা সুর লহরী শিল্পিী, সাহিত্যিক, গবেষক ও ভ্রমন পিপাসুদের মনে এন দেয় এক অনাবিল আনন্দ। এখানে গোটা বছর ছুটে আসেন ভ্রমন পিপাসু ও পর্যটকরা। সুউচ্চ পাহাড় শৃঙ্গ থেকে শুভ্র জলরাশি অবিরাম দ্রত গতিতে গড়িয়ে পড়ছে। পানি পতনের স্যাঁ স্যাঁ শব্দ অর্ধ কিলোমিটার দুর পর্যন্ত পর্যটকদের আকর্ষন করে। কখন শুরু আর কখন শেষ হবে স্রোত ধারা কেউ জানে না।
এখানে শীতের শুরুতে প্রচন্ড ভীড় জমে। শীত ছাড়াও দর্শনার্থীর কোলাহল মুখরিত থাকে গোটা বছর। জলপ্রপাতকে ঘিরে গড়ে তোলা হয়েছে ইকোপার্ক। গবেষক, পর্যটক, বিনোদন প্রিয় সৌখিন মানুষ এখানে এল খোঁজে নৈসর্গিক স্বাদ ও স্বর্গীয় অনুভূতি।
জলপ্রপাতের অবিরাম স্রোতধারা প্রবাহিত হওয়ায় পাহাড়েরর গা পুরোটাই কঠিন পাথরে পরিনত হয়েছে। জলরাশি নির্গত কুন্ডের ডানদিকে রয়েছে বিশাল গুহা। আদিম যুগের মানুষ গুহায় বসবাস করলেও আধুনিক যুগের মানুষ গুহার সাথে তেমন পরিচিত নয়। তবে মাধবকুন্ডে এলে গুহার ভেতর প্রবেশ করে নতুন আমেজ পাওয়া যায়। তাছাড়া বৃষ্টির মৌসুমেও শতাধিক দর্শনার্থী গুহায় আশ্রয় নিতে পারে। স্থানীয় ভাষায় গুহাকে ‘কাব’ বলা হয়ে থাকে। পাহাড়েরর গভীরে তৈরী গুহাকে মনে হবে আধুনিক কারুকচিত পাথরের একচালা। আদুনিক ভাষায় বলা যায় বাংলোর ফটক। গুহাটির সৃষ্টি প্রাকৃতিক ভাবে হয়েছে বলে অনেকে ধারনা করলেও মুলত এটি ছিল সন্যাসী মাধবেশ্বরের ধ্যান মগ্নের গোপন আস্তানা। এটি কিভাবে, করা তৈরী করেছিল তার সঠিক তথ্য আজও রহস্যাবৃত।
মাধবকুন্ড জলপ্রপাতে এলে চোখে পড়বে উচু নীচু পাহাড়ী টিলায় দিগন্ত জোড়া চা বাগান। টিলার ভাঁজে ভাঁজে খাসিয়াদের পান পুঞ্জি ও জুম চাষ। পাহাড়ীদের সনাতনী বাড়ি ঘর আর উপজাতি ললনাদের অর্ধ নগ্ন গোসলের দৃশ্য সত্যিই অপুর্ব। যা পর্যটকদের আনন্দই দেয়না, গবেষক ও কবি-সাহিত্যিকরা খোঁজে পায় রসালো লেখার রসদ।
মাধবকুন্ড অতিত থেকেই হিন্দু সম্প্রদায়ের তীর্থ স্থান হিসাবে পরিচিত। ভগবান মাধবেশ্বরের আশির্বাদ নিতে হাজার হাজার মানুষ আসেন প্রতি বছরের চৈত্র মাসে। এ সময় মধুকৃষনা ত্রয়োদশীতে পুণ্যার্জন ও বারুনী স্নান করে পাপ মুক্তির কামনা করেন। মাধবের মন্দির ছাড়াও রয়েছে শিব মন্দির। বিশালাকার শিবলিঙ্গ পুজা করাও হয়ে থাকে। চৈত্রমাসের ওই সময়ে বিশাল মেলা বসে। মেলায় আসলে শুন্যই নয় পাওয়া যায় মানসিক প্রশান্তি ও আনন্দ। অনেকে আনন্দ ভ্রমনে এসে সুবিশাল পর্বত শৃঙ্গে পাথর বেয়ে উঠে। কিন্তু সর্তকতার অভাবে ভয়াবহ দুর্ঘটনাও আশংকা রয়েছে। কর্তপ পাহাড়ে উঠা নিষেধ করলেও দুরন্ত সাহসী তরুনরা হিমালয় বিজয়ের স্বাদ নিতে চেষ্টা করে। উচু থেকে অবিরাম গড়ানো পানির স্রোতে সৃষ্টি কুন্ডটি প্রায় ২৫ ফুট গভীর। গত ৩ বছরের মধ্যেদুঃখ জনক ভাবে ৪/৫ জনের মৃত্যু হয়েছে হিম শিতল পানির পরশ পাওয়ার লোভে গভীর কুন্ডতে নেমে। পানিতে নামতে নিষেধ রয়েছে। এজন্য একটি সাইনবোর্ড দিয়ে সতর্ক করেছে কর্তêৃপ।
এ জলপ্রপাতের সুচনা কখন হয়েছিল তার সঠিক তথ্য পাওয়া না গেলেও ভূ-তাত্বিকদের ধারনা প্রায় হাজার বছর আগে হিন্দু ধর্মাবলম্বী সন্যাসী মাধবেশ্বর আস্তানা করেন। পাহাড় বেষ্টিত নির্জন স্থানে সন্যাসী ধ্যানে মগ্ন থাকতেন। মাধবেশ্বরের আস্তানা ঘেষে বয়ে গেছে একটি ঝরনা ধারা। এটি পাথারিয়া পাহাড়েরর প্রায় ২‘শ ৫০ ফুট উচু থেকে গা ঘেষে টিলার নীচুতে কল কল শব্দে প্রবাহিত পানি গভীর কুন্ড হয়ে ঝরনার সৃষ্টি করে। সন্যাসী তার প্রয়োজনীয় কাজ সম্পন্ন করতেন এই পাথর ঘেষা ঝরনার শীতল পানি দ্বারা। সন্যাসীকে ঘিরে প্রতিদিন আগমন ঘটতো পূন্যার্থীদের। সেই থেকে প্রাকৃতিক জলধারাটির নাম মাধব কুন্ড। মাধবকুন্ড জলপ্রপাতের ২ টি উল্লেখযোগ্য বৈশিষ্ট। দেশের সর্ববৃহত অকৃত্রিম জলপ্রপাত এবং হিন্দু সম্প্রদায়ের ধর্মীয় গুরুত্বপুর্ণ স্থান।
মৌলভীবাজার জেলার বড়লেখা উপজেলার কাঁঠালতলী থেকে মাত্র ৫ কিলোমিটার দুরে অবস্থিত মাধবকুন্ড। দেশের যোগাযোগ ব্যবস্থার উন্নয়নের সাথে মাধবকুন্ডে আসার সুবিধারও উন্নতি হয়েছে। দেশের যে কোন জায়গা থেকে সড়ক পথে সরাসরি বাস নিয়ে আসা যায়। তাছাড়া রেলপথেও সুবিধা আছে। ঢাকা, চট্টগ্রাম ও উত্তরাঞ্চলের পর্যটকরা রেল পথে আসতে হলে সিলেট গামী আন্তঃনগর ট্রেনে কুলাউড়া স্টেশন নেমে বাস, প্রইভেটকার, কিংবা টেম্পু, মিশুক নিয়েও মাধব কুন্ড যেতে পারেন। সড়ক পথে রিজার্ভ গাড়ী ছাড়াও চট্টগ্রাম অঞ্চলের জন্য বিআরটিসি স্পেশাল বাস এবং ঢাকা ও উত্তরাঞ্চেল জন্য শ্যামলী পরিবহনে সরাসরি বড়লেখা আসা যায়। বড়লেখা থেকে রিকসা যোগে কাঁঠালতলী হয়ে মাধব কুন্ড যেতে পারেন। বিদেশী পর্যটকদের জন্য রয়েছে ডাক বাংলো। জলপ্রপাতের প্রায় অর্ধকিলোমিটার পশ্চিমে পর্যটন কর্পোরেশনের ডাক বাংলো। সংশ্লিষ্ট কর্তৃপরে অনুমতি নিয়ে রাত যাপনের ব্যবস্থা আছে।
চলচিত্র শিল্পীরা এলে পর্যটন কর্পোরেশনের বাংলোতে রাত যাপন করেন। তাছাড়া ভ্রমনকারীদের সুবিধার্থে মানসম্মত খাবার ব্যবস্থা ও কেনা কাটার জন্য রয়েছে বাহারী পন্যের দোকান। মোট কথা মাধবকুন্ড জলপ্রপাত ও ইকোপার্কটি পর্যটক, গবেষক ও ভ্রমন পিপাসুদেরদের জন্য বিনোদনের খোরাক যোগাবে নিঃসন্দেহে।