৫
মর্ণিং–শো
টেবিলে চা এর সরঞ্জাম করা ছিল … দিবাকর আসতেই গরম চা আর সেই সাথে হালুয়া। হালুয়াটা নাসিম মাসীর করা … ওটা করার একটা স্পেশাল ফর্মূলা আছে নাসিম মাসীর। একটা চামচ মুখে দিয়েই দিবাকর বলল
– নাঃ, এটা খাবার নয়…
নাসিম মাসীসহ সবাই একদম থতমত… জয়া তো ঘাব্ড়েই গিয়েছে, বিলকুল …
– না, মাসীমা এটা খাবার নয়… এটা হচ্ছে অমৃত।
সত্যি–ই দিবাকর জাদু জানে… মুহূর্তে আবহাওয়াটা পাল্টে গেল…
– ওঃ দীপদা, সাত জন্মেও তোমার কোনও শত্রু হবে না।
হাসিতে ভরে গেল ঘর।
– মাসীমা, আমি রবিবার সিনেমার কতগুলি পাস পেয়েছি… যাবেন আমাদের সাথে? পুরোনো বাংলা ছবি…
– দূর পাগল, খেয়ে–দেয়ে আর কিছু কাজ নেই … সিনেমা যাও।
স্বভাবতঃ–ই সবাই কিছুটা নিরাশ… কিন্তু দিবাকর হাল ছাড়বে না। পুরোনো ভাল ছবি কিন্তু …
– কী সে ছবি?
– শিল্পী।
– শিল্পী! হ্যাঁ, ছবিটা ভাল ঠিকই … পাস পেয়েছ, কটা! চারজনের?
– তা, সেটা নষ্ট করে আর লাভ কি! ঠিক আছে… কিন্তু তারপর রান্না–বান্না কিন্তু তোমরা করবে। রাজী তো!
– খুউব রাজী মাসীমা…
– ওরে বাবা! দীপদা … তুমি করবে রান্না! মানে রবিবার আমাদের গণ–উপবাস।
– দেখা যাবে!
– কেন যে দীপের পিছু লাগিস!
– ঠিক বলেছেন মাসীমা…
– মা, তুমি বড় পক্ষপাতী … সব সময়–ই দীপের পক্ষে…
চেঁচিয়ে উঠল দুজনে।
***
রবিবারের বাজার। শহরের ঘুম ভাঙ্গেনি এখনও … এই আধ জাগ্রত, আধ নিদ্রামগ্ন। বাস–ট্রামগুলো সব প্রায় খালিই বলা যায়। দোকান–পাট খোলে নি সব এখনও। দুই এক জন লোক বাজারের থলি হাতে মন্থর গতিতে এদিক ওদিক হাঁটছে… লেক মার্কেট অথবা যগু বাজারের দিকে, আজ আর সে দ্রুততা নেই। সাতসকালে বাস–ট্রাম আর গাড়ির কানের–পর্দা ফাটানো গর্জন প্রায় নেই, নেই মহানগরীর পথিকের চঞ্চলতা। তাই, শহরের রাস্তা যাদের বেড–রুম, রবিবার–এর কল্যাণে তারাও একটু বেশী ঘুমোবার বিলাসিতার সুযোগ থেকে সম্পূর্ণ ভাবে বঞ্চিত হয় নি। একটু জাগো জাগো ভাব… কোথাও ট্যাঁ – ট্যাঁ করছে রাস্তার ধুলি মাখা কটা বাচ্চা, কোথাও বা কোন বাচ্চা আপ্রাণ চেষ্টা করছে তার ক্ষুধা নিবৃত করতে – নিরুপায় মায়ের শুষ্ক স্তনে। এদিক ওদিক আঁচ দেওয়া হচ্ছে কয়লার উনানে। কোথাও রাস্তার ধারে জলের ট্যাপ বা টিউব–কলের পাশে নিম–ডালের দাঁতন হাতে কেউ দাঁত ঘষছে। কেউবা এই সময়, ভীড় বারবার আগে ভাগেই ক‘ ঘটি জল ঢেলে নিয়েছে মাথায়। তাইতো … ধীরে ধীরে প্রাণ ফিরে আসছে নগরীতে।
কি মুশকিল, এই সময় এক কাপ চা–ও মেলা ভার। বনফুল রেস্টুরেন্টটা পর্যন্ত খোলে নি এখনও। চেয়ারগুলি সব টেবিলের ওপর।
যাক, পাসগুলো সব চেঞ্জ করা হয়েছে … শো সাড়ে দশটায়। সিনেমা হলের সামনে এতটা ভীড়ও নেই। এ ছবি অনেকে বহু বার দেখেছে। তবুও কিছু লোক আবার এসেছে দেখতে। হয়তবা কোন্ স্মৃতি জড়িত রয়েছে এর সাথে।
কটা মিনিট বাকী আছে সিনেমা হলের প্রথম অ্যালার্মটা পরতে – এখন ওরা এলেই হয়। অবশ্য এত তাড়াতাড়ির কিছু নেই… প্রথমে ত‘ ট্রেলার চলবে ওগুলো মিস্ করলে ক্ষতি নেই। তবুও, অন্ধকার হলে লোকের পা মাড়িয়ে সিট খোঁজা বড় যাচ্ছেতাই ব্যাপার! …ভাবতে ভাবতেই যাদবপুরের বাসটা এসে পড়ল।
– এই দীপদা! আমরা হাজির – জনাব!
– তাইতো, দেখছি সুখের ঘুমটা ভেঙ্গেছে সময় মত!
– আর বল কেন! ভাল করে ঘুমোতেই দিল না। ভোর না হতেই– চেঁচামেচি, ধাক্কা–ধাক্কি একেবারে হুলস্থুল কাণ্ড।ভাল করে একটা চা পর্যন্ত খাওয়া হয় নি। মা–টা একেবারে …
নাসিম মাসী হেসে বললেন–
– যত দোষ নন্দ ঘোষ – তাই না! সকাল সকাল না ওঠালে ত‘ আজ আর আসা হ‘ত না, মর্ণিং–শো তো দূরের কথা, ম্যাটিনী–ও হ‘ত কিনা সন্দেহ … সাজ–গোঁজ করতেই ত তোর দশ ঘণ্টা সময় লাগে। আর চা পাস নি আজ!
– আরে চা খাই নি তা কে বলেছে! ভাল করে আমেজ করে খাওয়া হয় নি … আর, বাইরে বেরুতে গেলে একটা ভাল কিছু তো পরতে হবে। রোজ রোজ তো আর সিনেমা দেখতে যাচ্ছি না!
– বেশ, বেশ এবার চল তো সবাই ভিতর য়াই। চা আমার–ও ঠিকমতো খাওয়া হয় নি। …আর আমীর ব্যাপার কি! তুমি বোবা হয়ে গেলে নাকি! একদম স্পীক–টি নট।
– বলবার সুযোগ থাকলে ত‘ বলবো। জয়া আর মা শুরু করলে – আমি নো হয়্যার। চল হলে যাওয়া যাক।
কিছু কিছু ফিল্ম আছে, যে গুলো দেখবার পরে আর মেয়েদের চোখের দিকে তাকানো চলে না। এই ছবিটাও সেই জাতীয়, নাসিম মাসীর ছল–ছল চোখ দেখে সঙ্কোচ হল দিবাকরের। পরিস্থিতি একটু সহজ করতে হবে…
– ওঃ, গলাটা শুকিয়ে একদম কাঠ হয়ে আছে। চলুন মাসীমা কোথাও বসে এক কাপ চা–কফি খেয়ে নেওয়া যাক। আমরা সবাই গড়িয়াহাট নেমে পরলে কেমন হয়? পথেই পরছে!
– হ্যাঁ, সেটাই ভাল। কফি তাহলে আমরা ঐ সাউথ ইন্ডিয়ান রেস্টুরেন্ট–এ খাব … কি মা?
আমীরের প্রস্তাবটা খারাপ ছিল না। গড়িয়াহাটএর সাউথ ইন্ডিয়ান রেস্টুরেন্টটা বেশ ছিম ছাম, চলছে বেশ। সন্ধ্যা বেলায় একটা খালি টেবিল মেলা ত‘ প্রায় দুঃসাধ্য ব্যাপার। আমীরের মতে – সবাই যখন এক সাথে রেস্টুরেন্টে কফি খাচ্ছে, তাহলে এর সাথে একটা ঢোসা মন্দ হয় না। তাই–ই হল– ঠিক। দুপুরের রান্নাটা স্থগিত রইল।
– যাও দীপদা, এবারের মত তোমার রেহাই হল।
– মানে?
– মানে, আজ আর তোমাকে রান্নাঘরে কেরামতি দেখাতে হবে না। আমরাও বাঁচলাম আজ আর উপোস দিতে হবে না – সবাইকে। তবে তোমায় ছাড়ছি না আমরা – তোমার রান্নার খেল না দেখে ছাড়ছি না – কিছুতেই।
– বড় জ্বালাতন করিস তোরা দীপকে…
– আঃ মাসীমা, পাগলের কথা ছেড়ে দিন … কিন্তু আপনার কি হল! মন মেজাজ ভাল নেই নাকি!
– না রে, তা নয়। ভালই লাগছে সবই … তবুও এখানে, সব কিছুর সাথে জড়িয়ে রয়েছে অনেক স্মৃতি … মনে হয় এই সে দিনের কথা। সিনেমা দেখা, কফি হাউস, মার্কেটের সামনে অথবা গোলপার্কের কাছে রাস্তায় ফুলওয়ালার রজনীগন্ধা আর জুঁই–এর মালা, অকারণে ছাতা থাকতেও বৃষ্টিতে ভেজা। কতবার যে এই রাস্তায় সুব্রতর সাথে হেঁটেছি … কখনও ঐ পানের দোকানে কোল্ড ড্রিংস্ কখনও রাস্তার মোড়ে দাঁড়িয়ে ফুচকা খাওয়া… এই সব স্মৃতি ভেসে আসে। আমরাও ছিলাম এক কালে আড্ডাবাজ। এ সব কথা মনটাকে একটু উদাস করে দেয়।
জয়া একটু পাশ ঘুরে দাঁড়াল… টস টস করে ঝরল ওর চোখের ক‘ ফোঁটা জল…। মা–কে দেখেছে ও কঠিন হাতে সব ঝড়–ঝাপটা সয়ে কাজ করতে … এমন তরো আবেগ ভরা প্রাণে দেখে নি কখনও।
… তবুও সুন্দর ছিল মর্ণিং–শো, সুন্দর ছিল দিনটা।
***
ক্রমশ
পূর্ব প্রকাশিত পর্ব [১] [২] [৩] [৪] পরবর্তী পর্ব [৬] [৭]