৩
তেলেভাজা
রাত হয়েছে অনেক। কেন যেন দিবাকরের ঘুম ভেঙ্গে গেল, ট্রেনের ঝাঁকুনিতেই হবে। বাইরে আলো–আঁধারের লুকোচুরি চলছে। চাঁদনী রাত কিন্তু এ চাঁদ এক লাজুক মেয়ের মত থেকে থেকে ঘন মেঘের ওড়নার অন্তরালে তার হাঁসিটাকে লুকোবার চেষ্টা করছে। আবার কখনও মুচকি হেসে আকুল করছে প্রেমিক প্রেমিকার কল্পনা–জগতকে। আকাশ ছড়ানো মেঘের দল জোট বেঁধেছে এলোমেলো হাওয়ার সাথে, মেতে উঠেছে সকলে লুকোচুরি খেলায়। দুই–এক ঝাপটা বৃষ্টিও হয়েছে মনে হয়, আলো–আঁধারে ঝিলমিল করছে লাইনের ধারে সার দিয়ে দাঁড়ানো গাছের বারিসিক্ত পত্ররাশি। আলো–আঁধিয়ার খেলার পর্ব শেষ হয়নি এখনও … রাত এখনও বাকি।
কোথাও মেঘাচ্ছন্ন অম্বর হার মানিয়েছে চাঁদটাকে সেই লুকোচুরি খেলায়… আঁধারের কোলে বিলীন হয়েছে আকাশ আর মাটির দূরত্ব… নেই কোনও দিক আর দিগন্ত। গ্রামগুলি কোনও অব্যক্ত বেদনা গোপন করতে পিছিয়ে পড়ছে পথের মাঝে। তারই অশ্রুসঞ্চিত বারিধারা ক্ষীণবেগে বইছে আঁধারের বুকে মৃদুস্পন্দন জাগিয়ে। দৃষ্টিগোচর না হলেও স্পর্শ করে সে স্পন্দন অনুভূতিকে … তার ঢেউ জাগায় হৃদয়ে দোলা…আলো–আঁধারের অস্ফুট হাতছানির নীরব আকর্ষণ নিয়ে চলে দূরে, বহু দূরে। ব‘য়ে আনে স্মৃতির উৎস হ‘তে কখনও আনন্দ কখনও–বা বেদনা–জড়িত পরশ। এ–তো নয় শূন্যতা … এ হ‘ল বলা আর না–বলা কথার গ্রন্থিত ছন্দ।
হেথা–সেথা রাতের সে মৌনতা ভঙ্গ করা ঝিঁ–ঝিঁ পোকার মুখরতা … তবুও হয়না ছন্দপতন।
কোথাও… হাজারো জোনাকি এক টুকরো তারকাময় আকাশের মত ছেয়ে আছে বনানী, … মিলনপ্রয়াসীর তৃষ্ণা জাগিয়ে। এ এক অদ্ভুত দৃশ্য। যেন আঁধারের বুকে ছড়ানো রাশি রাশি খসে পরা তারা আঁধারঘন গ্রামগুলিকে মৃদু আলোকের বরণ ডালিতে মনোরম করে তোলার প্রচেষ্টারত। আলো–আঁধারের প্রণয়ের মৌন নিবেদন।
ট্রেনের কামরার রাতের আলো জ্বলছে পিট–পিট করে, প্রায় সব যাত্রীরা নিদ্রামগ্ন। যাত্রীরা তাদের বাক্স–পেঁটরা সব শিকল–তালাবদ্ধ করে বাক্স হারানোর চিন্তা থেকে খালাস। কোথাও এক–দুই বাচ্চা কারণ অকারণ ট্যাঁ–ট্যাঁ করছে। কিছু যাত্রী জায়গা না পেয়ে কামরার মেঝেতেই শুয়ে পড়েছে, খবরের কাগজ বিছিয়ে। ট্রেনে দ্বিতীয় শ্রেণীর কামরায় এসব এখনও বরদাস্ত করা হয়। আর এতে কারই বা ক্ষতি! ট্রেনই তো দেশের সব স্বল্পবিত্ত্বের সাধারণ মানুষের একমাত্র পরিবহন। ট্রেনের সংখ্যাও পরিমিত তাই এ সহনশীলতার সমালোচনা নিষ্প্রয়োজন।
গাড়ির দোলা ঘুমের আবেশে জড়িয়েছে সবাইকে। রাতের প্রহরীরা টহল দিচ্ছে মাঝে মাঝে, তাদের বন্দুক পিঠে ঝুলিয়ে।
ঘুমটা সম্ভবতঃ আর আসবে না। দিবাকর চেয়ে আছে বাইরের দিকে… আঁধারটা ঘনিয়ে আছে এখনও, নেই কোথাও এক ছিটে আলো। এক বহু পরিচিত গানের কথা মনে পড়ছে… “অন্তরেতে দেখবো যখন আলোক নাহিরে …” রবি ঠাকুরের গান এটা… যে গেয়েছিল তাকে দিবাকর দেখতে শুরু করেছিল, “…চোখের বাহিরে” আর “অন্তরেতে…”।
গ্রাজুয়েশন–এর পর শুরু করেছে একটা ইন্টারন্যাশানাল কোম্পানিতে এক্সীকিউটিভ ট্রেনী হিসেবে। বন্ধুর কমতি ছিল না ওর কোনও দিন… আর তারই সাথে ছিল ফটোগ্রাফীর ঝোঁক্। টালীগঞ্জের ফিল্ম–স্টুডিও পাড়ার ছেলে, ফিল্ম পেত অঢেল। বন্ধুরাই যোগান দিত তার – তাই ছবি তুলবার কৃপণতা ছিল না একদম। অবসর সময়ের অনেকটা কাটত বন্ধুদের সাথে কফি–হাউসের আড্ডাতে, এদিক সেদিক বন্ধু–বান্ধবীদের বাড়ির চা, ঝাল–মুড়ি আর পেঁয়াজীর আসরে। আরে শুধু কি চা, অনেক সময় মা–মাসী বা বোন, বৌদি–রা ভাল–মন্দ না খাইয়ে ছাড়ত না একদম–ই। একবার কোনও বাড়িতে পা মাড়ালেই হ‘ল… বলে না, কোনও বাড়িতে আসাটা নিজের ইচ্ছায় – কিন্তু যাওয়াটা নয়। তাই–ই হ‘ত। সব পরিবারে ত‘ আর অন্নপূর্ণার ডালি থাকে না – তবুও টানা–টানির দিনেও, আকালের কালেও নিজের খাবার ভাগ করে খায় অতিথির সাথে … এ যে এক অলিখিত প্রথা। খাওয়ার থেকে খাওয়ানোর বেশী আনন্দ মেয়েদের, এ তো রয়েছে দেশের প্রতিটি ঘরে। সত্যি বলতে কি, এই আদরে ডাল–ভাতকেও অমৃত বলে মনে হয়। নাই বা হ‘ল বিরিয়ানী, ফ্রায়েড–চিকেন… মা–মেয়েদের আন্তরকিতায় তাদের হাতের ছোঁয়ায় সব কিছুই হয়ে ওঠে যেন পরমান্ন। ওদের গড়িয়ে দেওয়া এক গ্লাস ঠাণ্ডা জল আনে র্যালি সিং–এর লস্সীর থেকেও বেশি তৃপ্তি। অন্ততঃ দিবাকরের তো তাই মন হ‘ত।
এরই মাঝে, দিবাকর সপ্তাহের দুটো দিন টুক্ করে কেটে প‘রত ক‘টা ঘণ্টার জন্যে। এ সময়টা ছিল ম্যাক্স–মূলার ভবনে জার্মান ক্লাসের জন্যে বাঁধা… ভাষার সাথে ছিল হয়ত ওখানে আরও অন্য কিছুর টান। … যাক্, সেটা আবার পরে কখনও তলিয়ে দেখা যাবে।
মোট কথা দিনগুলি ছিল প্রোগ্রাম–বিহীন প্রোগ্রামে ঠাসা মানে যাকে বলে – প্যাক্ড্–আপ।
এরই মাঝে এলো বড়দিন – পঁচিশে ডিসেম্বর। হৈ–হুল্লোড় করে চারজন বন্ধু মিলে যাওয়া হ‘ল চিড়িয়াখানায় … ফটো তোলার নাকি দারুণ ব্যাকগ্রাউন্ড। হ্যাঁ, গেট পেরিয়ে ঢুকতে না–ঢুকতেই ব্যাকগ্রাউন্ড–এর উদয়… চপলতা উচ্ছ্বসিত হাসি আর কলরবে মাতিয়ে জন পাঁচেক কলেজ ছাত্রীর প্রবেশ দৃষ্টি আর শ্রবণীর আকর্ষণ করেছে সেকথা বলাই বাহুল্য।
***
বেশ চলছিল ট্রেনের ঝাঁকুনি আর দোলা, … তা মোটামুটি ভালই লাগছিল। এ দোলার আবেশেই হবে হ‘য়ত, সব যাত্রীগুলো.. ঐ হ‘ল, সবাই না হোক, বেশীর ভাগ… হ্যাঁ, প্রায় সবাই ঘুমচ্ছে বেহুঁশের মত। আর ফেলে আসা দিন দিনগুলি সুযোগ পেয়ে ঘুর–ঘুর করে লাইন মারছে দিবাকরের স্মৃতির দুয়ারে। একবার এ দুয়ার খুললেই হ‘ল… হুড়–মুড় করে স্মৃতিগুলো… না, আর ঢুকবার অবকাশ পাবার আগেই – ক্যাঁর–খ্যাঁর করে ব্রেক মেরে থেমে গেল গাড়িটা… রেড সিগন্যাল হবে হয়ত।
একটু যে তন্দ্রার ভাব এসেছিল, তাও উবে গেল – নিঃশেষে।
বাইরে এখনও অন্ধকার, টিপ–টিপ করে বৃ্ষ্টিও পড়ছে। ট্রেনের জানালাটা ভিজে রয়েছে, কামরাটাতে ভেপসা গন্ধ, ফ্যানগুলো সব ঘুরছে ঠিকই কিন্তু জানালাগুলি বন্ধ থাকলে এর কি আর কোনও সুরাহা হয়! যাকগে, ট্রেনটা থামায় একটু নিস্তার ত‘ পাওয়া গেল – মন্দেয় ভালো।
… বর্ষণমন্দ্রিত কলকাতার সে দিনগুলির আবেশ এখনও মলিন হ’য়ে বিলীন হয়নি অতীতের আঁধারে। সারাটা দিন রিম–ঝিম বারীশ, মেঘের ঘনঘটা আর তারই ফাঁকে ফাঁকে কখনও লাজুক অরুণ–কিরণ; সিক্ত সরণী – এথা হোথা পীচ ভাঙ্গা রাস্তায় জমে থাকা ঘোলা জল, বাসে ট্রামের ভিড়ে গুঁতো–গুঁতি, কোনায় কোনায় হরেক রকম সোঁদা সোঁদা গন্ধ। এদিক সেদিক পথধারে ফুলের ব্যাপারি —জুঁই আর রজনীগন্ধার সৌরভ । সেই সাথে পাল্লা দিয়ে বিলিয়ে চলেছে মেয়েদের কবরীর সিক্ত যূথিকা তার আবেশভরা সুবাস। বষর্ণমুখর দিনশেষে পথের ধারে ছাপরা থেকে ভেসে আসা তেলেভাজার গন্ধ… লোভনীয় সে আকর্ষণ উপেক্ষা করার উপায়টা খুঁজে পাওয়া খুব একটা সহজ ব্যাপার নয়!! পথপ্রান্তে তেলেভাজার বাস বশ করেছে সকল ঋতুতেই — শীতের কুয়াষাচ্ছন্ন সন্ধ্যায় মুখরোচক সে ভাজা আর্দ্র করে তুলেছে মুখটা বারংবার; আঃ – তুলনাহীন … হ্যাঁ ঐ চার–পাঁচটা তারা ঝোলানো আর জেল্লা ধরানো রেস্টুরেন্টগুলিও সে তৃপ্তি যোগাতে পারবেনা, একথা কিন্তু হলপ করে বলা চলে।
এমনই এক ঝিম্–ঝিমে বৃষ্টিঝড়া সন্ধ্যায় বাস স্ট্যান্ডের পাশের ঐ নামকরা তেলে ভাজাওয়ালা দৃষ্টিগোচর হওয়া মাত্রই রোশনি–ইন্দ্রিয় সাড়া দিয়ে উঠল – তা হবে না! ওর ভাজার জন্যে হরদম ভীড় থাকে। এই বৃষ্টিতেও দাঁড়িয়ে আছে গোটা–কয়েক ছেলে–মেয়ে লোভ সামলাতে না পেরে। এক ঠোঙা গরমা গরম তেলেভাজা… দামটা দিতে গিয়ে দশটা পয়সা কম পড়ছে। কি আর করা যায়… দশ টাকার নোটটা বার করতেই– ভাজিওয়ালা নারাজ।
– দশটা পয়সার জন্যে দশ টাকার ভাংতি দিই … এ কেমন কথা হ‘ল, বলুন তো।
– আরে, আমার যে আর ভাংতি পয়সা নেই – তা হলে একটা ভাজি কমিয়ে দিন…
পাশেই দাঁড়িয়ে থাকা হাওয়াই শার্ট পরা ছেলেটা, তার জন্যে এগিয়ে দেওয়া ঠোঙাটা নিতে নিতেই বলে উঠল –
– নাঃ, কমাবার দরকার নেই… ঐ দশটা পয়সা আমিই দিচ্ছি।
– বা, রে! তুমি কেন দেবে!
– তোমার ওই দশ পয়সার জন্যে দশ টাকার ভাংতি তো কোথাও মিলবে না। পাশের ওই চা–এর দোকানটাতে গিয়ে বস ত‘ দেখি… আমি আসছি দামটা মিটিয়ে। তখন সব হিসেব নিকেশ হবে।
অগত্যা দিবাকর গিয়ে বসল একটা বেঞ্চে … তেলেভাজাটার ঠোঙা হাতে। দু–গ্লাস চা–এর অর্ডার দিয়ে ছেলেটা, মানে হাওয়াই–শার্ট পরা যুবক–ছেলেটা এসে বসল দিবাকরের মুখোমুখি মানে উল্টোদিকের বেঞ্চে।
– বাঃ, তুমি ত‘ আবার চা–এর অর্ডার দিলে … দামটা দিই কি ক‘রে! আমার তো…।
– দশ টাকার নোট! এই তো! ভাঙ্গতে আর হবে না … পয়সাটা আমিই দিচ্ছি। ভাজির সাথে চা না হলে কি আর ভাল লাগে!
– হ্যাঁ, ঠিক তা ব‘লে…
– আরে, ঠিক আছে, ঠিক আছে … যদি তোমার আঁতে ঘা লেগে থাকে, তাহলে আমার বাড়ি গিয়ে হিসেবটা মিটিয়ে দিয়ে আসবে।
আমার নাম আমীর… এই আমার ঠিকানা – যাদবপুরে ….
একটা কাগজে খস্–খস্ করে ঠিকানাটা লিখে দিবাকরের হাতে ধরিয়ে দিল। কাল শনিবার, বিকেল চারটে নাগাদ চলে এস।
লোভে পরে অনেকগুলো ভাজা কেনা হয়ে গিয়েছে। কাছেই দুজন বাস কন্ডাক্টর চা খাচ্ছিল। ভাজির ঠোঙা দুটো এগিয়ে ধরে বলল..
– ও, দাদা! তেলেভাজা খাবেন! আমাদের খুব বেশী হয়ে গিয়েছে।
– কি হ‘ল পারছেন না, নাকি?
– না, খুব পারছি, কিন্তু বাড়িতে যে অমৃত পরে আছে … সে গুলোর কি হবে?
বাড়িতে মেয়েরা খাবার নিয়ে অপেক্ষা করছে তাদের প্রিয়জনের ঘর ফিরবার পথ চেয়ে। ভাল–মন্দ কিছু রান্না হয়েছে সারাটা সন্ধ্যা জুড়ে – কয়লা অথবা কাঠ–খড়ির ধোঁয়াতে চোখ কচলাতে আর চোখের জল ফেলতে ফেলতে। চপ–কাটলেট না হলেও ও খাবার না খেয়ে কোনও উপায় নেই। নইলেই, হ‘ল আরকি – মান–অভিমান, চোখের জল, যেন জ্যান্ত মানুষটার আস্ত হৃৎপিণ্ডটা টেনে–হিঁচড়ে বার করা হ‘য়েছে… এই তো ব্যাপার। সব বাড়িতেই চলছে এসব … মানে, যে সব পরিবারে আধুনিক সাহেবিয়ানার ঢুকবার সুযোগ এখনও মেলে নি। তা, এ কথা ওই কন্ডাক্টরদের–ও অজানা ছিল না …
– দিন তা হ‘লে … ধন্যবাদ…
চা, মানে কন্ডেন্সড মিল্ক আর চিনির সুপের গ্লাসে শেষ চুমুকটা দিয়ে হাঁটা দিল‘ ওরা বাড়ির দিকে।
– তা হলে কাল বিকেলে …
– ও. কে.
***
ক্রমশ
পূর্ব প্রকাশিত পর্ব [১] [২] পরবর্তী পর্ব [৪] [৫] [৬] [৭]