২
চা–ওয়ালা
ট্রেনটা চলেছে শহরতলীর মাঝ দিয়ে … ঘুট–ঘুট করে, মন্থর গতিতে হেলে–দুলে। এক ধারে নগরীর অট্টালিকা, বিলাসিতার প্রাচুর্য্য, তারই পাশে এ সব বস্তি, অস্তিত্বের লড়াই, শুধুমাত্র টিঁকে থাকা নিয়ে ধাক্কা–ধাক্কি। এ যেন আলো–আঁধারের সহবাস। আঁধার বিনা আলোর কি কদর থাকে? তা–ই ভাঙ্গা ছাপড়া, বস্তি না থাকলে অট্টালিকার বিলাস–নিবাসের পানে কি আর কেউ চেয়ে থাকত ঈর্ষা জড়িত দৃষ্টিতে? … আরে না–না, ঈর্ষা জড়িত দৃষ্টিতে ক্ষতি কোথা? এই–ই তো সচ্ছ্বল গোষ্ঠীর মলম, প্রাচুর্য্যগলিত হৃদয়ে ঈর্ষা–ই উপযুক্ত মলম।
আরে দেখে দেখে সবাইকার সয়ে গিয়েছে, নইলে মগজটা বিগড়ে যেতো হয়ত।
বস্তিগুলি পিছনে রেখে ট্রেনটার গতি একটু বেড়েছে, এখন খোলা মাঠ আর গাছগুলো হু–হু করে ছুটে চলেছে পিছু পানে, এগিয়ে চলেছে যাত্রীসকল।
চা–কফির কেটলী নিয়ে হাঁকা–হাঁকি করছে হকারগুলো
“কফি … কফি: চায় গরম…”।
“এই–যে ভাই একটা চা দিন তো”।
কার উদ্দেশ্যে বলা হ’ল কথাটা … চা বিক্রেতা ঠিকমত উপলব্ধি করে উঠতে না পেরে একবার ঘাড়টা ঘুড়িয়ে ফ্যাল–ফ্যাল করে চাইল বক্তার প্রতি। ভালো পরিষ্কার পোষাক পরা এক লোক, তার দাঁড়িটা আবার সৌখিন ভাবে কাটা … আরে ছাই, এ কার ম’ত হবে দাঁড়িটা! উঁ–হুঁ, মনে পড়ছে না ঠিক মত, দুত্তোর দাঁড়ি তো আছে অনেক বাবুদের … এতো আজকাল স্টাইল। এ বাবু–লোক কি এক সামান্য ফেরিওয়ালার সাথে ভদ্রভাষায় আপনি–টাপনি ক’রে কথা বলবে! আরে ও তো সাত জন্মেও শোনেনি বাবু–সাবদের কাছ থেকে আপনি ক’রে সম্বোধন করতে। তুই–তোকারি শুনতে অভ্যেস হ’য়ে গিয়েছে। … শুধু কি এই বাবুরা! ওদের বচ্চা–কাচ্চাগুলোও ধার ধারেনা সামান্য একটা ভদ্রতার, হ্যাঁ–হ্যাঁ, ওরা তো ভদ্দর–সমাজের তাই হুকুম করাটা যেন জন্মগত অধিকার।
না, শুনতে ভুল হ’য়ে থাকবে, ভাবলো চা–ওয়ালা …
“কি চা আছে নাকি, দিন তো এক কাপ”।
এইতো ঠিকই শুনেছে, এত দিন বড়–ছোট নির্বিশেষে সবাইকে বলেছে আপনি ক’রে, আজ অপ্রত্যাশিতভাবে এক বাবুর মুখে এই সম্বোধন যেন অবিভূত করে দিল ওকে।
“হ্যাঁ–হ্যাঁ, আছে বৈকি, দিচ্ছি এক্ষুনি”।
সযত্নে ভ’রে দিল ছোট প্লাস্টিকের পাত্রটা কানায় কানায়; হাতে গরম লাগতে পরে ভেবে আবও একটা প্লাস্টিক লাগিয়ে দিল চা–পাত্রটার বাইরে।
“দেখবেন গরম আছে চা–টা”।
“সুক্রীয়া”।
… মানে ধন্যবাদ? এ কি হ’ল! হুকুম শোনার অভ্যস্থ কানে লাগছে এসব যাদুর মত। চা–এর চারটে টাকা কেটে বাকী টাকাটা ফেরত্ দিয়ে চলে যাওয়ার সময় ঘাড় ফিরিয়ে দাঁড়িওয়ালা বাবুকে আরও একবার দেখে নিল। বাড়ী গিয়ে বৌ–টাকে বলতে হবে কথাটা।
হ্যাঁ,বৌ–টাকে ভালোকিছু বলবার মত তো কিছুই থাকে না কোনও দিন। থাকবেই বা কিভাবে! গোটা দিন ধরে এই ট্রেনে ট্রেনে ফেরি করে অনেক রাতে ডেড়া ফিরে মেজাজটা হ’য়ে থাকে ঐ চা–কেটলীটার মতই গরম। সারাটা দিন অনেক বাবুলোকের দুর্ব্যাবহার হজম করে বাড়ী ফিরে বৌ–টাকে একটু পেটালেও রাগটা কমে, গরম মেজাজটাতে একটু ঠান্ডা জলের ঝাপটার মতই লাগে। কেন যে পেটায় সে তা নিজেই জানে না, অনেকটা অভ্যেসের মতই হয়ে দাঁড়িয়েছে এটা।
অনেক দিন মানে অনেকগুলো বছর কেটেছে বৌটা ঘরে এসেছে। কেন যেন মনে পরে গেল। বিয়ে–ফিয়ে করবার ভাবনা হ’ত–ই না তখন ওর। এদিক ওদিক আড্ডা দিত অন্যসব ছোঁড়াদের সাথে, লুকিয়ে বিড়ি ফুঁকতে শুরু করেছে সবেমাত্র। ব্ল্যাকে সিনেমার টিকিট বিক্রী করতে শিখেছে ইদানিং, এতে চলে যেত মোটামুটিভাবে মাঝে–সাঝে রাস্তার ধারে অথবা পার্কের ঐ কোনটিতে গোলগাপ্পা গিলে নিয়ে বিড়ি ধরাবার খরচাটা।
বাপের পকেট মারবার কথা ভাবলেই রাগ হ’ত ওর, বাপের ঐ হাজারটা তালিমারা শতছিন্ন জামার পকেটে কিছু থাকলে তো সে প্রশ্ন আসতো। আর পকেটে থাকবেই বা কি ক‘রে? বাপ, কাছের রেলস্টেশনে মোট বইত, তাও আবার বে–আইনিতে। কুলির লাইসেন্স ছিলনা, তাই বেশী পয়সাও চাইতে পারত না। যা–ও বা পেত তার ওপরেও ভাগ বসাত অনেকে। কি আর করবে ও হতভাগা, স্টেশনে টিঁকতে গেলে এটা তো আছেই।
এতে তো আর মুখের ভাত জোটেনা দু–বেলা, তাই ওর মাকেও রোজগার করবার ধান্ধা করতে হ’ত। আশে–পাশে বাড়ী তৈরির কাজে ইঁট, সিমেন্ট আর ঝুড়ি বোঝাই মাটি বওয়া, মানে যোগাদারির যত‘ সব কাজ।
এই করেই চলছিল কোনওমতে দিনগুলি। গাঁয়ের এক লোকের প্রস্তাব বাপের কাছে বেশ মনঃপুত হ’ল, পাঁচশো–এক টাকা হাতে গুনে নিয়ে ছেলের বিয়ে ঠিক হ’ল সে লোকটার মেয়ের সাথে। বিহারে, পাটনার কাছাকাছি হবে… আরে কাছাকাছি মানে দূর কোনও গ্রামে … ঐ ধ্যার–ধ্যারা কোনোও এক গোবিন্দপুর হ‘বে আর কি। কে আর সে গাঁয়ের নামটা শুনে উদ্ধার হ‘তে গিয়েছে। না–ই বা হ‘ল সে গাঁয়ের নাম শোনা… ঐ ছোট্ট গ্রামেই কারবাইডের আলো জ্বালিয়ে, খ্যাঁর–খেঁরে মাইকে হিন্দী–ফিল্মের গান বাজিয়ে বিয়েটা হ’ল।
হ্যাঁ, বলা চলে বেশ ধুম–ধাম করেই। আর কিছু না হোক গোটা কয়েক হিন্দী গানের কথা “হারানো সুর”–এর মত এখনও কেন যেন আবছা ভাবে মনে ভাসে।
***
লাল শাড়ী আর দু–হাতে একগাদা কাঁচের চুরি, মেয়েটা এল বৌ হয়ে। এ যে এখনও কিশোরী, নারীত্বের শুধু আভাষ মাত্র প্রকাশিত হয়েছে তার অঙ্গে, কুশুম পরিস্ফুটিত হবার আগেই হল বৃন্তচ্যূত।
ছোঁড়াটার অবশ্য তখন এটা খুব একটা বোধগম্য হয়েছে, তা নয়। নারী–সৌন্দর্য্যের আকর্ষণবোধ তখনও ওর ঠিকমত জাগেনি। সিনেমা হলের সম্মুখে অনেক যৌবন ভরা মেয়ে দৃষ্টিগোচর হয়েছে। কখনও বাড়ী তৈরীর কাজের যোগানদারি উচ্ছ্বলিত যৌবনের মেয়ে নজরে এসেছে, দেখেছে দু–একবার দুরন্ত হাওয়া খসিয়ে দিয়েছে এদের কারও বুকের আভরন। হয়ত কোনও অজানা কারনে তার ভালই লেগেছে, পুলকিত হয়েছে তার মন। তবে তেমন একটা অনুভূতি গজায়নি তখনও। কচি, কিশোরী বৌ–এর তনু নিয়ে মাথা ঘামায়নি খুব একটা, তবুও একটা কিছু খোঁচ–খোঁচ করত মনে।
কি নিয়ে আর মাথা ঘামাবে! বাপ–মায়ের খ্যাঁচ–খ্যাঁচানি তো লেগেই আছে, আজকাল এসেছে আবার নূতন আপদ, ঐ বৌ–টার ঘ্যান–ঘ্যানানি।
রোজগারের কিছু একটা ধান্ধা করতে হবে, সিনেমার টিকেট ব্ল্যাকে বিক্রীর বাজারটাও চলে না তেমন করে। আজকাল ঘরে ঘরে টি–ভি, সিনেমার আকর্ষন কমে গিয়েছে, তাই ব্ল্যাকের বাজার একদম কাত্। দুটো বিড়ি–সিগারেট ফুঁকবার পয়সাটা মেলে, কিন্তু পেটে গুঁজবার কিছু আর কেনা চলে না এতে। বাপ–মা আর খাওয়াবে না, বুঝতে পারছে। এখন আবার ঘাড়ের উপর এসে জুটেছে মেয়েটা।
… শালা, মেজাজটা গরম হবে না? হবে বৈ–কি!
একদিন তো ধাঁ করে হাত উঠে গেল বৌএর ওপর। তারপর থেকে চলে এর পুনরাবৃত্তি।
দুর্বলের ওপর বলপ্রয়োগ করাটা যে সহজ। দুর্বলের আবার প্রতিবাদ, প্রতিরোধ!
বৌ–টাকে মারবে না? আলবত্ মারবে … এতো প্রায় বাপের সম্পত্তি। আরে দূর… বাপের সম্পত্তি হ‘তে যাবে কেন ! বাপের সম্পত্তি হ‘লে রক্ষা করতে হ‘ত … এটা তো পরের বাড়ীর মেয়ে। ওকে ঘরে এনে তো ছুঁড়িটার বাপ–মায়ের চোদ্দপুরুষ উদ্ধার ক‘রেছে… তা একটু–আধটু হাত চরবেই তো, কে ঠেকাবে?
আজও ঘরে ঘরে চলছে বৌ–প্যাঁদানি। হ্যাঁ, হ্যাঁ সব সম্প্রদায়েই চলছে এই বদমায়েশী, এ ক্রিমিনালিটি, নেই এ ক্ষেত্রে উচ্চ–নীচের প্রভেদ। এ ব্যাপারে এরা সবাই নীচে, মানবিকতার সবচাইতে নীচের ধাপেরও নীচে। এর নাম পাশবিকতা।
অদ্ভুত ব্যাপার, সেই প্রাচীন কাল থেকে আজ অবধি, বেশীর ভাগ মেয়েরা সব নির্য্যাতন মুখ বুঁজে, প্রায় বিনা প্রতিবাদে সহ্য করছে। কপালটা মন্দ হ’লে সংসারটা শুধু মাত্র বর–বধু নিয়ে নয়, বরের মা–বাপ, বড়–ছোট ভাই–বোন, আরও অনেকে গিঁজ–গিঁজ করে বাড়ীতে। বৌ–ঠ্যাঙ্গানিতে শাশুরী আর ননদেরাও বা পিছিয়ে থাকবে কেন! পরের বাড়ীর মেয়েকে একলা হাতে পেয়ে এরা বীরাঙ্গীনি। চমত্কার, শাশুরীও যখন নববধু হ’য়ে এসেছিল, তখন তাকেও হয়ত হজম করতে হয়েছে অনেক রকম নির্য্যাতন … দৈহিক আর মানসিক। আর আজ? বধুর যাতনা বুঝবার চেষ্টা করা তো দূরের কথা, আগুনে তেল ঢালতে একটুকু পিছিয়ে থাকে না।
***
আগুনে তেল ঢালার কথা? তেল মানে কেরোসিনের দামটা বাজারে খুব চড়ে যাওয়ায় নাকি বৌ–পোরানোটা একটু ক‘মেছে। তবুও শোনা যায়… যত সব বাড়ীতে আগুনে পোড়ার কেস্ আসে হাসপাতালে তার বেশীর ভাগ, ধরতে গেলে শতকরা আশীভাগ ভিক্টিম হচ্ছে নাকি মেয়েরা।
যদি প্রশ্ন ওঠে…
“তা, আগুনটা ধরে কিভাবে? আর মেয়েদের সংখ্যা এত বেশী কেন? পুলিশ রিপোর্ট …”
“পুলিশ রিপোর্ট? টিপিক্যাল, প্রায় সবই এক ধরনের … ঘরের কাজে, বিশেষতঃ রান্নাঘরে দুঘর্টনা।”
“পুলিশ তদন্ত হয় না?”
“তদন্ত হয় বৈকি … বাড়ীর অর্থাত্ সব সাক্ষী এক মত – দুঘর্টনা। সাধারনতঃ, তদন্তর এখানেই ইতি, আর এগোয় না।”
ব্যাস্ …! হ্যাঁ, ব্যাস্ …! সন্দেহ থাকলেও, পুলিশও ঘাঁটায় না ব্যাপারটা খুব বেশী। গনতান্ত্রিক দেশ, নারী–পুরুষের তো সমান অধিকার এখানে ! হ্যাঁ, আইনতঃ, নারী–পুরুষের সমান অধিকার, একথা অস্বীকার করা চলে না। কিন্তু! কিন্তু, দুঃক্ষের বিষয়, একথা আমাদের দেশের সব মানুষগুলোর মগজে ঢোকেনি ঠিকমত।
আধুনিক বিজ্ঞানের অগ্রগতিকে অস্বীকার করার উপায় নেই… অজাত শিশুর যৌন নির্ধারন করা অতি সহজ আর সাধারন ব্যাপার বটে… কিন্তু অজাত কণ্যার এ্যাবর্শান করাটা নারী–হত্যার ক্রীমিনালিটির সামিল বৈকি। এর ব্যাপকতায় উত্তর ভারতের কোনও কোনও অঞ্চলে বিবাহ যোগ্য মেয়ের সংখ্যা এতটা হ্রাস হয়েছে যে বহু ক্ষেত্রে পরিবার গঠন অসম্ভব হ‘য়ে দাঁড়িয়েছে। হ্যাঁ… একেই বলে বুমেরাং–টা আসছে ফিরে।
থাক তবে এ কথা।
ওই চা–ওয়ালার প্রসঙ্গে আসা যাক আবার … ওর আগেকার সঙ্গীরাও সব ভেগে পরেছে একে একে।
বাড়ীর কাছেই, দু-রাস্তা পেরোলেই চোখে পরে, বড় রাস্তার কর্ণারে, পান–সিগারেটের দোকান আর তার পাশে চা–রেস্টুরেন্ট। বেশ চলছে আজকাল, লোকের আনাগোনা বেড়েছে। গাড়ী, ট্যাক্সির ড্রাইভারগুলো সকাল, দুপুরে গাড়ী থামিয়ে খেয়ে নেয় পেট ভরে।
দেখা যাক না একবার মালিককে জিজ্ঞাসা করে, কাজের লোক লাগলেও লাগতে পারে। কথাটা ঠিকই, রেস্টুরেন্টটা বেশ চলছে, আর লোকেরও দরকার। সময় মতই জিজ্ঞাসা করেছিল মালিককে, কাজের সুরাহা হ’ল। খাবার দেওয়া আর কখনও বর্তন পরিষ্কার করার কাজ। মন্দ নয়, আঝে–মাঝে দুই এক পয়সা বকশিশও মেলে।
বৌ–এর ঘর–দোর পরিষ্কার করার কাজ জুটলো এক ড্রাইভারের মালিক সাহেবের বাড়ীতে। গাঁয়ের মেয়ে, সহরের হাল–চাল সব–ই ছিল তার সম্পূর্ণভাবে অজানা। প্রথমদিকে ভয় লাগত সব কিছুতে, এখন সয়ে গিয়েছে।
পাশের বস্তিতে একটা ঘর মিলে গেল দৈবাত্। একটা ঘর তার সংলগ্ন ছাউনি দেওয়া উঠান, বারিষকালেও খাবার পাকানো চলে।
দিন, মাস আর বত্সর অতিবাহিত হ’য়েছে কতগুলি। সেদিনের সেই কিশোরী দেহেতে ভরা যৌবনের ঢেউ। ভাল করে বৌ–কে দেখবার মত অবকাশ ছিল না আর তার প্রয়াসও করেনি। কাজ সমাপনে দিনশেষে যখন ঘরে ফেরে কালি–ঝুল ধরা কেরোসিনের লন্ঠনের আলোয় ডাল আর চাপাটি–দুটো দেখতে পায় এই–ই যথেষ্ট। লন্ঠনের ফিতেটা কাটেনি কেউ, ধোঁয়ায় আর কেরোসিনের গন্ধে ভ্যাপসা হ’য়ে গিয়েছে ঘর। বৌ–এর গতর দেখবার সাধ হয় না ওর, কেরোসিনের দামও উঠছে ওপর দিকে।
বাবু তার পরিবার নিয়ে দিন–দুই–এক জন্যে শহরের বাইরে কোথাও গিয়েছে, বৌ–এর তাই দু–দিনের ছুটি। একবার সিনেমায় গেলে মন্দ হ’ত না। মালিককে অনেককিছু বলে–কয়ে সাঁজের আগেই ঘরে এল।
বিকেলবেলা, সূর্যটা হেলে পড়েছে, কিন্তু গরম খুববেশী কমেনি। বৌ সবেমাত্র স্নান সেরে ঘরে এসে, মেঝের টুল–এর ওপর বসেছে চিরুনী হাতে, ছোট্ট আয়নাটা সামনে রেখে। আর কোথা থেকে একঝলক আলো চুপি চুপি ঢুকে পরেছে ভাঙ্গা জানালার ফাঁক দিয়ে। সিক্ত, কৃষ্ণবর্ণ চুলেরগুচ্ছ এলোমেলো ভাবে পিঠে ছড়ানো, সদ্য স্নানসিক্ত শারী আরও খানিকটা ভিজে জড়িয়ে ধরেছে নবযৌবনকে মধুর আলীঙ্গনে। খেটে–খাওয়া অভাবগ্রস্থ, অনাদরে বিকশিত নারী, রুক্ষ বনাণীতে প্রস্ফুটিত এক অনামী কুশুম; মেদবিহীন সুগঠিত সে তনু, যেন শিল্পীর বহু যত্নের সৃষ্টি। প্রয়োজন হয়নি তার বডি–বিল্ডিং আর ফিটনেসের ব্যায়ামাগার, বিউটি পার্লার দেখেনি সে কখনও ভেতর থেকে।
নূতন দৃষ্টিতে দেখল বৌকে, এতদিন তো দেখেছে, এ সৌন্দর্য্য দেখবার আর উপলব্ধি করার অন্তর ছিল অবরুদ্ধ। মৃদুভাবে ডাকল’–
“এই শোন্”
“হ্যাঁ, বল“
আশ্চর্য্য, কোনও মুখ ঝামটা নয়, মোলায়েম আবেগভরা কন্ঠ, অবিভুত করে দিল ওকে।
“না, কিছু না, এমনি–ই ডাকলাম তোকে”।
ধীর পায়ে কাছে এসে, অতি সন্তপর্নে তুলে ধরলো বৌকে, মধুর প্রেমালিঙ্গনে স্নিগ্ধ হ’ল দুজনার ব্যাকুল হৃদয়।
***
শারীর আঁচল খসে গিয়েছে, তা আগলাবার ত্বরা নেই। ভালবাসার সোহাগপূর্ণ স্পর্শ প্রেমের প্রথম ছোঁয়াসম উদ্বেল, আকুল করে তুলল সবর্শরীর। চঞ্চল হৃদয়স্পন্দন–অনুভূতি প্রবাহিত হল ত্বকে লোমকুপ থেকে লোমকুপে।
ধিরে, মৃদুস্বরে বললো বৌ–কে,-
“তুই তো ভারী সুন্দর …”
“কত দিন, কতবার তো দেখেছ আমাকে, কিন্তু আগে তো কখনও ব’ল নি …”
“দেখবার এ চোখ ছিল কোথায় …!”
অলক্ষে সিক্ত হ’ল চোখের কোন … এক বিন্দু অশ্রুকণা, ভালবাসা উদ্বেলিত নারীহৃদয়; প্রেমের নিঃশব্দ আনন্দধারা।
সিনেমায় যাওয়ার কথা ভুলে গেল দুজনেই।
কতগুলো দিন, বছর কেটে গিয়েছে মাঝখানে। সে রেস্টুরেন্টটাও আর নেই, বন্ধ হয়ে গিয়েছে অনেকদিন হল। কিছুদিন চেষ্টা করেছিল সব্জী বিক্রী করার। সাত–সকালে পাইকারী বাজার থেকে আনাজ খরিদ করে খুচরো বাজার আর রাস্তায় রাস্তায় বসেছে কতদিন। ঠিক সুবিধে করে উঠতে পারে নি; দু–পয়সার মাল নিয়ে বাবুরা করে দু–ঘন্টা দরাদরি।
এখন ফেরি করে ট্রেনে–ট্রেনে চা–কফি।
জীবনটা তো সিনেমা–জগত্ নয়, যে হটাত্ বরাত খুলে যাবে …!
তবুও এই চা–কফির দৌলতে সংসারটা চলে যাচ্ছে কোনও ভাবে। অবস্থাটা কিছুটা ভালো হয়েছে, এটা বলতেই হবে। পাশের বাড়ী থেকে আনা বিজলী–তারে একটা বাল্ব লাগিয়ে হ্যারিকেনের ঝামেলাটা মিটেছে। এজন্যে ওদেরকে মাসে মাসে একটু বেশী পয়সা দিতে হয় অবশ্য, কিন্তু বিজলী আলোর সুবিধে তো পাওয়া যাচ্ছে। বাড়ীওয়ালার মর্জী হলে নিজস্ব বিজলী মিটার পাওয়া যাবে ইলেক্ট্রিক কোম্পানীর… মালিক ব্যাটা এতদিনে রাজী হয়েছে অনুমতি দিতে।
বেচারি বৌ–টা! বাচ্চা হবার পরে বাবুরা আর কাজ দেয়নি। তিন, তিনটে ছেলে মেয়ে, ঐ প্রাইমারী স্কুলের বেশী আর হল না। এলোমেলো ভাবনাগুলো স্তব্ধ করে দিল ওকে, ক্ষনিকের তরে। একটা দীঘর্র্শ্বাশ বেরুলো … অজান্তে অনিচ্ছাতেই। না, বৌটাকে আর পেটাবে না।
পরের স্টেশনটা প্রায় এসে গিযেছে, নেমে উল্টো দিকের ট্রেন পাকরাতে হবে। কেটলিটা হাতে নিয়ে ছুটলো দরজার দিকে।
“কফি … কফি; চায় গরম ।…”
***
… ক্রমশ
পূর্ব প্রকাশিত পর্ব [১] পরবর্তী পর্ব [৩] [৪] [৫] [৬] [৭]