১
স্ফুলিঙ্গ
কলকাতার ছেলে দীবাকর, সে বহুদিন বহু বৎসর হ’ল ঘরের বাইরে মানে ভারতের বাইরে… জার্মানী প্রবাসী। ইওরোপ থেকে ভারতে আসবার সময় দীবাকর সাধারনতঃ মুম্বাই অথবা দিল্লিতে নেমে ক’টা দিন এ শহরে কাটিয়ে ট্রেনে কলকাতা আসে। বিভিন্ন রকমের যাত্রীদের সাথে ট্রেনের দীর্ঘযাত্রার সময়টা কেটে যায় ভাল-মন্দের মিশ্রণে, নানা রকম গল্প-গুজবে, তর্ক-বিতর্কে।
স্টেশন থেকে বেরিয়ে শহরের বহুতল বাড়ীগুলিকে পিছে রেখে এগিয়ে চলে ট্রেনটা শহরতলীর আঁকা-বাঁকা লাইনের ওপর দিয়ে। লাইনের ধারে ছাপরা-বস্তী। মরচেধরা টিন,ছেঁড়া চট, প্লাস্টিকের বস্তা আর বাঁশের চাঁটাই বা আধ-পচা কাটের টুকরো দিয়ে তৈরি আস্তানায় কোনওমতে মাথাগুঁজে থাকে অগনিত মানুষের দল। গরু, কুকুর, বখরী আর সব পশু-পাখীদের পাশা-পাশি বাঁচবার প্রতিযোগিতা চলছে পুরোদমে। শতছিদ্র মলিন বস্ত্র দ্বারা লজ্জ্বা নিবারনের প্রয়াস বৌ-মেয়েদের।
আঙ্গিনায়, ছোট্টো মাঠে, পথের বাঁকে অথবা পানাভরা ডোবার ঘাটের ধারে খেলছে কতগুলো বাচ্চা, কারও পড়নে ছেঁড়া কালো হ’য়ে যাওয়া হাফ্-প্যান্ট, হয়ত কোনওকালে এর কিছু একটা রং ছিল, … আর ঐ মেয়েটার গায়ে একটা কিছু, যার নাম ছিল কখনও … ফ্রক্। আর অন্য ছোঁড়া-ছুঁড়ীদের তো তাও যোটেনি, ন্যাংটো হ’য়ে ছোটা-ছুটি করছে; আর কতগুলো চ্যাঁচাচ্ছে হ্যাঁ-হ্যাঁ করে।
সব শহরের আশে-পাশে এই একই দৃশ্য … না, কেবল মাত্র শহরতরলিতে নয়, শহরের মাঝে বিভিন্ন এলাকায় ছড়িয়ে রয়েছে অগনিত ভাগ্যাহত মানুষের মাথা গোঁজবার ঠাঁই এই সব বস্তী, … পরিচয় বিহীন মানবসন্তানের শুধু অস্তিত্ব।
সন্ধ্যেয় নেই সেথা ঘরে ঘরে নিওন আলোর ঝলকানী, হ্যারিকেনের মিট-মিট করা আলো আর এদিক ওদিক একটা-দুটো ভাগ্যবান বসিন্দার বিজলী-বাল্ব চেষ্টা করে চলেছে আঁধারঘন রাতটি একটু আলোকিত করে তুলতে।
ট্রেন-টা চলেছে মন্থরগতিতে … প্রাতঃকর্মসমাপন উদ্দ্যশ্যে, শরমের মাথা খেয়ে, লাইনের ধারে লাইন দিয়ে ব’সেছে অনেকে লোটা হাতে, কারও হাতে বিসলেরির পুরোন প্লাস্টিক বোতল … না, শুধু বিসলেরি কেন হ’তে যাবে, অন্য কোনও মিনারাল জলের বোতলও হ’তে পারে।
আজকাল তো ভুরি-ভুরি জলের কোম্পানী গজিয়েছে ব্যাঙএর ছাতার মত সরাটা দেশ জুড়ে, তারই কোনও একটা হবে।দুর ছাই, কে আর তাই নিয়ে মাথা ঘামাতে যাচ্ছে! কেনই বা মিনারাল জলের কোম্পানী গজাবে না? মিউনিসিপালিটির জলের তো নেই কোনও ভরসা, সরবরাহ নেই পর্য্যাপ্ত পরিমানে আর যা-ও বা মেলে তা নাকি ভুর-ভুর করছে জীবানুতে, খেয়েছ ত’ মরেছ। যাদের এই বোতলের জল কিনবার মত দু-টো অতিরিক্ত পয়সা আর প্রানের মায়া আছে, তারাই কেনে এ জল।
এত-ই কি দরিদ্র এ দেশটা, যে ঠিকমত জলটা পর্য্যন্ত মেলা ভার! এ প্রশ্ন সবাইকার মনে মাঝে-সাঝে জাগে বটে … কিন্তু নিত্য দিনের নিত্য নূতন ঝামেলার মাঝখানে কোথায় যেন তলিয়ে যায় এ কথা। অবশ্য বিশ্মৃতির কোলে হারিয়ে যায় না দৈনন্দিন সমস্যার কথাগুলো… পুঞ্জীভুত হচ্ছে যব সব ক্ষোভ মনের কোনে, কখনও বিষাদের রূপে, কখনও বা তিক্ততায় ভরা।
***
ভারতে ট্রেনে বিশেষতঃ দূরপাল্লার গাড়ীতে নিঃসঙ্গতার বালাই একদমই থাকেনা বললে খুব একটা ভুল হ’বে না… বলা চলে। এ কথা দীবাকরের অজানা ছিলনা, দীবাকর নিজেও কখনও মুখচোরা ছিল না, তাই সহযাত্রীদের সাথে পরচিতি হ’তে খুব একটা বেশি সময়ের দরকার হ’য় নি। দীবাকর জার্মানীতে থাকে, ছুটিতে সপরিবারে এসেছে ভারতে, আর ওর বৌ জার্মান মেয়ে… গাড়ীর চাকাগুলো ঘুড়তে শুরু করতে না করতেই এ কথা জানতে বাকি রইলনা, কারও। ট্রেনে সহযাত্রীদের আসরটা জমতে শুরু করেছে, ছোট-খাট কথা-বার্তা একটু আলোচনা… এ যাকে পশ্চিমী ভাষায় “স্মল টক্” বলা হ’য়। পাশের বার্থগুলিতে… এক ভদ্রলোক দিব্বি তার দৈনিক কাগজটা নিয়ে ব্যাস্ত, আর অন্য যাত্রীদের কেউ চলচ্চিত্র অথবা অন্য কোনও সাপ্তাহিক কাগজে মগ্ন, কেউ বা খোলা জানালার পাশে বসে শুধু বাইরের দিকে তাকিয়ে সময়টা কাটাবার চেষ্টা করছে। বেলা বাড়ছে আর তার সাথে বাড়ছে ধীরে ধীরে গরমটাও।
ঐ ভদ্রলোক খবরের কাগজটা ভাঁজ করতে করতে হু-ট করে প্রশ্ন করে বসলো, –
“আরে মশাই, ট্যাক্স-ফ্যাক্স-এর টাকাগুলো যাচ্ছে কোথায়?”
এর আর কি উত্তর আছে! … এক যাত্রী আমতা আমতা ক’রে কিছু একটা বলবার চেষ্টা করাতেই ফুঁশ করে অন্য একজন বলে উঠলো –
“আরে বলুন না স্যার, বলেই ফেলুন না যা আপনি ভাবছেন … জনগনের পকেট খালি হ’চ্ছে আর… টাকার বড় ভাগটা যে রাজনিতীর হোমরা-চোমরা বাবুদের পেটে গিয়ে ওইখানেই হজম হচ্ছে আর তার যেটুকু উচ্ছিষ্ট থাকছে সেটারও ভাগ-বাঁটোয়ারা হচ্ছে অফিসের বাবুদের থলিয়াতে।”
“আরে মশাই সত্যি কথা বলতে কি আপনার জিভটা নড়তে চাইছে না! বলেই ফেলুন না আপনি যা ভাবছেন, আহা কেউ জানে না বুঝি!…”
একটু উত্তেজিত আর বেশ নাটকীয় স্বর ছিল ঐ ভদ্রলোকের ভাব-ভঙ্গীতে। এখন তার নজরে এল দীবাকর।
“আপনি মশাই দেশের বাইরে থাকেন, তাই ব’লে কিচ্ছু খবর রাখেন না না-কি! কলিকাল চলছে মশাই … কলিকাল চলছে।”
ভদ্রলোকের মাথাটা একটু গরম হ’য়ে গিয়েছে বলে মনে হল …
একটু থেমে, দুই পাশের পকেট হাতরিয়ে একটা রুমাল দিয়ে প্রথমে মুখের বাঁ-দিকটাতে দুবার ঘষে তারপর ডানদিটা ধীরে ধিরে মুছে নিয়ে বলতে শুরু করলেন…
“দেখবেন, … এ একবার তোলপার হয়ে যাবে বলছি, … দেখবেন, সব বাবুদের বাবুগিরি একটা দিন খতম হ’য়ে যাবে, ওলোট-পালোট হ’য়ে যাবে মশাই … সব কিছু।”
কথা বলার ঢং-টা মন্দ নয় ভদ্রলোকের, শুরু হয় নীচুগলায় তারপর উঠতে থাকে তার কন্ঠস্বর। জল আর ঘাঁটাবার সাহস হল না দীবাকরের।
কলিকাল-টালের কথা না হয় না-ই হল, আসল কথাটা তো ভুল নয়, করাপশন্ … ঘুঁষ, নৈতিক অবনতী গোটা দেশ জুরে। এসব তো নূতন কথা নয়, এ চলছে … আর চলছে … সাধারন লোকেরা একথা জানে না – এটা সম্ভবতঃ পুরোপুরি ভাবেই ভুল ধারনা।
মনে হল বারুদের স্তুপ জমে রয়েছে, কখনও একটা ফুলকি পড়লেই হল … একটা স্ফুলিঙ্গ, তারপর আকাশ বিদীর্ণ বিস্ফোরণ।
****
… ক্রমশ