“বিশ্বের যে কয়টি দেশে বাল্যবিবাহের হার বেশি, এর মধ্যে বাংলাদেশ অন্যতম।” দৈনিক প্রথম আলোর আগস্ট ১৪, ২০০৯ সংখ্যার একটি প্রথম পৃষ্ঠার খবরের অন্যতম প্রধান বিষয়বস্তু। আমার প্রশ্ন হলো- কেন? উত্তর না পাওয়া যাক, একটু ভেবে দেখতে অসুবিধা কি। একটি ধর্মীয় সম্প্রদায়ের আদিযুগের একটি সমাজ-ব্যবস্থা যাকে আমরা এই যুগে কুসংস্কার বলে ঘৃণা করি, সেই ব্যবস্থা এই আধুনিক যুগেও কেন আমাদের পিছু ছাড়ছে না। নির্দিষ্ট ধর্মের গণ্ডি ছাড়িয়ে এটা কিন্তু দেশের পুরো সমাজ ব্যবস্থারই একটা রোগ। হুম্ আসল সমস্যাটা কোথায়- একটু ভেবে দেখতে অসুবিধা কি।
খবরটা নিচে তুলে দেয়া হলো-
———————————————–
দেশে ৬৬ শতাংশ মেয়ে বাল্যবিবাহের শিকার
আইন বলছে, ১৮ বছরের নিচে মেয়েদের বিয়ে দেওয়া দণ্ডনীয় অপরাধ। অথচ সরকারি-বেসরকারি বিভিন্ন তথ্যমতে, দেশে বর্তমানে গড়ে সাড়ে ১৫ বছর বয়সে মেয়েদের বিয়ে হচ্ছে। সামাজিক নিরাপত্তাহীনতা, বয়সের সঙ্গে সঙ্গে যৌতুকের পরিমাণ বেড়ে যাওয়ার বিষয়গুলোকে মেয়েদের তাড়াতাড়ি বিয়ে দিয়ে দেওয়ার কারণ হিসেবে দেখাচ্ছেন অভিভাবকেরা।
ন্যাশনাল ইনস্টিটিউট অব পপুলেশন রিসার্চ অ্যান্ড ট্রেনিংয়ের (নিপোর্ট) প্রতিবেদন অনুযায়ী, বাংলাদেশে ১৮ বছর বয়স হওয়ার আগেই ৬৬ শতাংশ মেয়ের বিয়ে হয় এবং দুই দশক ধরে এ হার প্রায় অপরিবর্তিত রয়েছে। এদিকে বাংলাদেশ ডেমোগ্রাফিক অ্যান্ড হেল্থ সার্ভে ২০০৭ (বিডিএইচএস) অনুযায়ী, এ হার ৭০-এর কাছাকাছি। একই প্রতিবেদনে মেয়েদের গড় বিয়ের বয়স সাড়ে ১৫ বছরে দাঁড়িয়েছে বলে দাবি করা হয়েছে।
বিশ্বের যে কয়টি দেশে বাল্যবিবাহের হার বেশি, এর মধ্যে বাংলাদেশ অন্যতম। সরকার থেকে অবৈতনিক শিক্ষা, উপবৃত্তির ব্যবস্থা করা সত্ত্বেও কমছে না এ প্রবণতা। এমনকি আইন করে ১৮ বছরের নিচে মেয়েদের বিয়ে দেওয়া দণ্ডনীয় অপরাধ বলা হলেও বাল্যবিবাহ ঠেকানো যাচ্ছে না।
দেশে বর্তমানে ১৩ থেকে ১৪ বছর বয়সেই মেয়েদের বিয়ে হচ্ছে বেশি। বাল্যবিবাহ এবং অল্প বয়সে সন্তান ধারণের প্রবণতা পরিবর্তনে মেয়েদের মাধ্যমিক শিক্ষা এবং গ্রামের মেয়েদের কর্মসংস্থানের পাশাপাশি কিশোরীদের মধ্যে বাল্যবিবাহবিরোধী কণ্ঠস্বর জোরদারের প্রয়োজনীয়তার কথা বলছে নারী ও শিশু বিষয়ে কর্মরত সংস্থাগুলো।
ইউনিটারিয়ান সার্ভিস কমিটি কানাডার (ইউএসসি) তথ্য উল্লেখ করে বিশেষজ্ঞ এম এ জামান বলেন, ‘৭০ শতাংশ ক্ষেত্রে বরের বয়স ১৮ বছরের নিচে এবং ২৬ শতাংশ ক্ষেত্রে ১৩ বছরের মধ্যে মেয়েদের বিয়ে হয়ে যাওয়ায় পরিস্থিতির ভয়াবহতা বাড়ছে। সামগ্রিক পরিস্থিতি পাল্টাতে হলে অভিভাবকদের সচেতনতা বাড়ানোর দিকে জোর দিতে হবে।’ সেটা কীভাবে সম্ভব সে প্রশ্নে তিনি বলেন, বাল্যবিবাহের ফলে তাদের সন্তানদের মৃত্যুঝুঁকি বেড়ে যাওয়ার বিষয়গুলো বেশি করে জানানো এবং বয়স বাড়লেও বিয়ে হবে আবার যৌতুকের পরিমাণ বাড়বে না বলে নিশ্চয়তা দেওয়া গেলে কোনো অভিভাবকই তাঁদের সন্তানদের এই পরিস্থিতির মুখোমুখি হতে দিতে চাইবেন না।
মানুষের জন্য ফাউন্ডেশনের নির্বাহী পরিচালক শাহীন আনাম বলেন, ‘মেয়েপক্ষ মনে করে, কম বয়সে বিয়ে না দিলে পরে অনেক বেশি যৌতুক দিতে হবে। এটা ভাবে না যে কম বয়সে বিয়ে দিলেও পরে যৌতুকের চাহিদা থাকে এবং সময়ে সময়ে তা বাড়তেও পারে।’
বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরো ও জাতিসংঘ শিশু তহবিলের (ইউনিসেফ) যৌথ জরিপ ‘প্রগতির পথে’র তথ্যমতে, উত্তরাঞ্চলের চরাঞ্চল এবং বরেন্দ্র এলাকায় ২০ থেকে ৪৯ বছর বয়সী নারীদের ৭৪ শতাংশেরই ১৮ বছর হওয়ার আগেই বিয়ে হয়েছে। তারা বলছে, দারিদ্র্য, মেয়েশিশুর নিরাপত্তা, পরিবারের সম্মান রাখার দায়-এসবই বাল্যবিবাহের মূল কারণ।
পরিস্থিতির বর্ণনায় জাতীয় মহিলা আইনজীবী সমিতির নির্বাহী পরিচালক সালমা আলী বলেন, ‘কিছু কিছু ক্ষেত্রে বিশেষত যেখানে অর্থনৈতিক অবস্থা নাজুক, অভিভাবকেরা মাথা থেকে বোঝা নামানোর জন্য নারী পাচারকারীর সঙ্গেও বিয়ে দিতে দ্বিধা করেন না।’ ভয়াবহ বাল্যবিবাহের এলাকা হিসেবে চিহ্নিত রাজশাহী অঞ্চলের ৬৫ দশমিক ২ ভাগ কিশোরীর বিয়ে হয় ১৫ থেকে ১৮ বছরের মধ্যে। বর ও কনের বয়সের পার্থক্যটাও অনেক বেশি থাকে।
ইউএনএফপিএর গবেষণা মতে, উন্নয়নশীল দেশগুলোর ১০ থেকে ১৭ বছর বয়সী আট কোটি ২০ লাখ কন্যাশিশুর বিয়ে হয় প্রাপ্তবয়স্ক হওয়ার আগে। এরা মানসিক, শারীরিক ও যৌনজীবনে ক্ষতির সম্মুখীন হয়। বাল্যবিবাহের কারণে স্কুল থেকে ঝরে পড়ার হার বাড়ছে এবং সামাজিক যোগাযোগের সুযোগ কমছে। ৫৫ শতাংশ কন্যাশিশু মাধ্যমিকে ঝরে পড়ে বিয়ের পর স্বামীর সংসারে কায়িকশ্রম দেওয়ার কারণে।
আইন ও সালিশ কেন্দ্রের নির্বাহী পরিচালক সুলতানা কামাল বাল্যবিবাহের কারণের কথা বলতে গিয়ে প্রথমে দায়ী করেন সর্বজনীন পারিবারিক আইন না থাকাকে। তিনি বলেন, ‘জন্মনিবন্ধন না থাকার কারণে মেয়েদের প্রকৃত বয়স প্রমাণের রাস্তা বন্ধ হয়ে যায়। অপ্রাপ্তবয়স্ক যে কাউকে টাকার বিনিময়ে প্রাপ্তবয়স্ক বানিয়ে দেওয়ার যে অবৈধ পদ্ধতি তা শক্ত হাতে প্রতিহত না করলে বাল্যবিবাহ ঠেকানো অসম্ভব। ইউএনএফপিএ, জাতীয় মহিলা আইনজীবী সমিতি ও নওগাঁ হিউম্যান রাইটস ডেভেলপমেন্ট অ্যাসোসিয়েশনের পৃথক গবেষণায় কন্যাশিশুকে সামাজিক নিরাপত্তা না দিতে পারা, বিয়ের প্রস্তাবে রাজি না হলে এসিড-সন্ত্রাসের শিকার হওয়ার ভীতির সম্ভাবনার বিষয়কে বাল্যবিবাহের কারণ হিসেবে চিহ্নিত করা হয়েছে।
কিশোরীদের পাশে কিশোরীরা
ইউনিসেফের সহযোগিতায় কিশোরীদের সচেতন করার কার্যক্রম পরিচালনা করছে কিশোরীরাই। ২৮টি জেলার তিন হাজার কিশোরী সামাজিক ব্যাধিগুলো নিয়ে কথা বলার কাজ শুরু করেছে। বাল্যবিবাহ প্রতিরোধের বিষয়ে এই কিশোরীদের অর্জন ইতিবাচক জানিয়ে ইউনিসেফের কিশোরী যুব কর্মকর্তা সায়লা পারভীন লুনা বলেন, ‘ওদের মাধ্যমে ওদেরই অধিকার রক্ষা করার বিষয়টি আগ্রহোদ্দীপক হিসেবে কার্যকর হচ্ছে বলে মনে করছি। তবে মানবাধিকার কর্মীরা বলছেন, সম্মিলিত প্রতিরোধ আর জন্মনিবন্ধনের ব্যাপারটা যদি একসঙ্গে নিশ্চিত করা না যায়, তাহলে বাল্যবিবাহ রোধে বাংলাদেশ সফল হবে না।’
উদিসা ইসলাম
সূত্রঃ প্রথম আলো, আগস্ট ১৪, ২০০৯