“এক ছিল রাখাল সে খুব দুষ্টু্…” না দিদা সেই উড়ন্ত কচ্ছপের গল্প গুলো বলো যারা রাতের জোনাকিদের সাথে কথা বলতো আর সবার খবর নিয়ে যেত নীল সমুদ্রের সেই রানীর কাছে…।
দিদা মুখে একটা পানের খিলি পুরে বলতেন “আচ্ছা বাপু দাঁড়া দিকিনি…বেলের সরবতটা এইবেলা একটু খেয়ে নে…এর পরেই গাজনের সঙ বেরোবে তখন কিন্তু আর খাওয়ার সময় পাবিনা।”
চৈত্র দিনের বেলা শেষে আমার তখন গাজনের সঙের থেকেও বেশি করে টানছে নীল সমুদ্রের সেই উড়ন্ত কচ্ছপেরা…যারা এবার খবর দেবে মৌমাছিদের বনে বনে ফুলের মধু খাওয়ার সময় এসেছে…
“কিন্তু ওরা কেন দেবে দিদা? মৌমাছিরা নিজেরাই তো সব জানে…”
“আহঃ তুই থামবি…সবজান্তা…” দিদা ধমক দেয়…।
“আমার বইতে সব লেখা আছে”…অভিমানী আমি পাশ ফিরে শুই…
“দিদা আবার শুরু করে আরে এইসব উড়ন্ত কচ্ছপেরা তো সেই তোদের বইগুলো যখন লেখা হয়নি তখন থেকেই ছিল…”
আমি কথা বাড়াই না…কারণ নীল সমুদ্র আমাকে ডাকছে। চৈত্রের দুপুরে আর কিছুক্ষণের মধ্যে বাগদী পাড়া থেকে সঙ বেরোবে…আমাদের উঠোনে এসে নাচবেন শিব পার্বতী…আর দিদা পাঁচুকে বলবেন “ওদের সবাইকে সিধে দাও”।
করিমচাচা বিকেলে আসবেন ঝুড়ি ভর্তি করে তালের পাটালী নিয়ে, “ন্যান ঠাকরুন…আজ বেলাবেলি বেইরে পড়েছি…হর গৌরীর পালা শুরুর মাথাটায় না পৌঁছিলে বাজার ধরতে পারবো না।”
“করিম একটু দাঁড়াও…। বড় ঘেমেছো…একটু বেলের পানা খেয়ে যাও…।”
সমুদ্রের হাওয়া এসে লাগে আমার গায়ে। ডিসেম্বরের পুরীর ভিড়। নীল সমুদ্র আমার সামনে…দিদা মারা গেছেন সেই কবে…মামার বাড়ির দালান কোঠায় আজ বাদুরের বাসা…কিন্তু এখনো তো রয়ে গেছে চৈত্রের দুপুর…তাল পাটালি…বেলের সরবত আর সেই উড়ন্ত কচ্ছপেরা…।
“সত্যি কি তাই আছে নাকি উড়ন্ত কচ্ছপ?” আমার মামার মেয়ে হ্যারি পটার পড়ে…কিন্তু তবুও সে হাসে… “গুল দিচ্ছ দাদা…গুল…”।
একটু আনমনা হয়ে পড়ি সামনেই ভিড়ে গিজ গিজ পুরীর সী বিচ। হঠাত দেখি একটা কচ্ছপকে…অবাক হয়ে যাই…এত ভিড়ে…এই সময়ে? সামনে গিয়ে দেখি সেটি মৃত।
মুখ থুবড়ে পড়ে আছে। কাছাকাছি কয়েকজনকে জিজ্ঞেস করলাম কোথা থেকে এলো এই কচ্ছপটি…কিভাবে মারা গেল? কেউ কিছু বলতে পারলো না। সী-বিচে টহলদারী পুলিশকে গিয়ে বললাম,“একটা মরা কচ্ছপ…বেশ বড়…আসলে এগুলোতো endangered।” পুলিশটি আমার দিকে কিছুক্ষণ ফ্যাল-ফ্যাল করে তাকিয়ে থেকে বললো,“ঘুরতে এসেছেন ঘুরুন…মজা করুন…এই সবের মধ্যে যাবেন না।”
এটা আমার প্রথম পুরী ভ্রমণ। এর আগে অনেকের মুখে শোনা গল্প আর তাদের তোলা ছবি দেখে আমার পুরীর সাথে পরিচয়। কিন্তু এই প্রথম এসে কি দেখলাম আমি? ২০ থেকে ২৫ ডিসেম্বর,২০০৮ আমার কাছে স্মরণীয়। কারণ প্রতিদিন সী-বীচে গিয়ে আমি দু-তিনটে করে কচ্ছপ মরে পড়ে থাকতে দেখেছি। আর সমুদ্রের অতল গহ্বর থেকে সেই সমুদ্রের রানীর গলায় আমার দিদা বলে চলেছেন “তারপর সেই উড়ুক্কুরা মহানন্দে চললো নগর প্রদক্ষিণে…”।
“রাতে তারা খবর এনে দিলো রানীকে…এবার ঝিনুক মুক্তো দেবে…সেই মুক্তোর মালা পড়বে রাজকন্যে…কোটাল পুত্রের ভারী রাগ…সাজা দিতে চায় উড়ন্ত কচ্ছপকে…কিন্তু অতই কি সোজা? ওরা যে জোনাকিদের সাথে কথা বলে…”। দিদা বলে, আমি শুনি আর রাতে গিয়ে দেখি আরো একটা মৃত কচ্ছপ…।
কিভাবে মরে এরা? না কোনো প্রাকৃতিক কারণে নয়। আমরাই মেরে ফেলি এদের…মেরে ফেলি নিজেদের স্বার্থে…ভালোভাবে চোখের দিকে নজর রাখুন…কিছু দেখতে পাচ্ছেন কি? অসীম শূন্যতা…রূপকথার গল্প…না আরো কিছু?…
এক স্থানীয় মতস্যজীবি জানালেন কি ভাবে এদের মারা হয়। “গভীর সমুদ্রে বড় বড় জালের মধ্যে মাছের সাথে উঠে আসে এই বিশালাকার বিরল প্রজাতির কচ্ছপগুলো। মাছ গুলোর সাথেই এদের নৌকোতে তোলা হয়। তারপর যেটা হয় সেটা ভয়ানক…। মাছগুলোর থেকে এদেরকে আলাদা করার জন্য তখন এদের পিঠের ওপরের খোলে লোহার ভারী বেলচা বা ওই জাতীয় কিছু দিয়ে আঘাত করা হয়। যন্ত্রণাতে বেরিয়ে আসে খোলসের মধ্যে ঢুকে থাকা ভয় পাওয়া মুখটা। তারপর সেই নরম মাংসালু মুন্ডুটায় চোখটাকে লক্ষ্য করে গেঁথে দেওয়া হয় লোহার বড়শি…তারপর ফেলা হয় সমুদ্রে। ছটফট করতে করতে মরে যায় কচ্ছপগুলো। তারপর কোনো এক সময় এরা সমুদ্রের পাড়ে ফিরে আসে কুকুরের খাবার আর আপনাদের ছবির বিষয় হিসাবে।”
আমি চুপ করে শুনেছিলাম গল্পটা। যিনি বলছিলেন তিনিও মাছ ধরেন। সত্যি-মিথ্যে বিচারের দিকে আমি যাইনি। পরের দিন যে কচ্ছপটা আবার পাড়ে এসে ঠেকলো তার চোখের দিকে তাকালাম শুধু। আমার ক্যামেরা ক্লিক করলো…।
সেদিন পঁচিশে ডিসেম্বর। পুরীতে একটাও হলিডে হোম, হোটেল, ধর্মশালা খালি নেই। লোক গিজগিজ করছে। আমরা সবাই এসেছি শ্রী শ্রী ধামে পূণ্য অর্জন করতে। সেদিনও আবার দুটি মৃতদেহ। “এতো সবেও আমাদের চৈতন্য হয় না। হয় না…আর হবেও না…কারণ বহুদিন আগে এই সমুদ্রেই চৈতন্য বিলীন হয়েছিলেন।” পাশ থেকে বলে ওঠে আমার পরিবেশ প্রেমী বন্ধু…সে এর মধ্যে তার অত্যাধুনিক মোবাইল থেকে মেইল করতে শুরু করে দিয়েছে…আর আমি শুনতে পাচ্ছি…দেখতে পাচ্ছি উড়ন্ত কচ্ছপেরা দল বেঁধে উড়ে চলেছে…শীতের খবর দেবে হরিখালের ঝিলে বসা রাজহাঁস গুলোকে…বলবে করিম চাচার পুকুরে আছে অনেক মিষ্টি স্বাদের গেঁড়ি গুগলি…তারা যেন সবাই দল বেঁধে সেখানে যায়…।
আমার চোখ ঝাপসা হতে শুরু করে আমি দেখি উড়ন্ত কচ্ছপের দল…আমার দিদার পানের খিলি খাওয়া কষ্ট পাওয়া মুখ…
সত্যি তোমার কচ্ছপ গুলো যদি উড়তে পারতো দিদা…
সত্যি তাদের যদি দুটো ডানা থাকতো…।