“প্রাচ্য সম্পর্কে বিদেশিদের কৌতূহলের সুযোগটিকে কাজে না লাগানোর আমাদের কোনোও কারণ নেই। কিন্তু তার মানে এই নয় যে, আমরা তাঁদের ছদ্ম-ভিনদেশি-নতুনত্ব-প্রীতির তালে তাল মেলাব। আমাদের দেশ এবং আমাদের দেশবাসী সম্পর্কে অনেক ধারণা তাঁদের মন থেকে দূর করতে হবে। চলচ্চিত্রের বাণিজ্যিক স্বার্থের দিক থেকে সেইসব অলীক ধারণা দূর না করে টিকিয়ে রাখা যদি অধিকতর লাভজনক হয়, তবুও।” – সত্যজিত রায়
দেশীয় সংস্কৃতির বেড়া ডিঙিয়ে বিদেশের সঙ্গে আমাদের আদান-প্রদানের, কথোপকথনের প্রয়াস কী হবে আর কী হবে না তার একটা গুরুত্বপূর্ণ ভেদরেখা টেনেছিলেন সত্যজিত। এরকম একটা লেখা যখন নিজের মনের মধ্যে বাসা বাঁধছে, কাগজে কলমে লিখছেন, তখন সত্যজিতের বিদেশে পরিচিতি বেশ ভালোই। কারণ তার দুবছর আগে কান চলচ্চিত্র উতসবে বিশেষ পুরষ্কার পেয়েছে পথের পাঁচালী আর ঠিক এক বছর আগে ভেনিসে গ্রাঁ প্রি পেয়েছে অপরাজিত। দারিদ্রের মূর্ছনায় শাদা পর্দা তোলপাড় হয়েছে। একটা ছবি হাঁ করে বসে দেখেছে গোটা দেশ তারপর গোটা বিশ্ব। পরের প্রজন্মের চিত্র পরিচালকেরা পেয়েছেন নতুন পথ, ভেবেছেন এইভাবেও ছবি করা যায়। শ্যাম বেনেগাল এক সাক্ষাতকারে জানাচ্ছেন পথের পাঁচালী দেখার পর তিনি উদ্বুদ্ধ হয়েছিলেন, মনে হয়েছিলো ছবি করাটাই হবে তাঁর পেশা। ঘাড়ে করে বয়ে বেড়িয়েছিলেন পথের পাঁচালীর প্রিন্ট, দেখিয়ে ছিলেন অনেককে। পার্লামেন্টে ঝড় উঠেছিলো ছবিটিকে নিয়ে। নার্গিস বলেছিলেন দারিদ্রকে বেচা হচ্ছে বিদেশের বাজারে, জবাব দিয়েছিলেন সদ্য স্বাধীন ভারতের প্রথম প্রধান মন্ত্রী নেহেরু, ভারতে যদি দারিদ্র্য থাকে তাহলে সে দারিদ্র্যকে লুকোনোর কোনো অর্থ নেই।
সত্যিই আমরা লুকোইনি অনেক কিছুই। সাংস্কৃতিক ভাবের আদান প্রদানের যে সাবধানতার কথা সত্যজিত আমাদের বলেছিলেন তা মেনে চলতেন সেই সময়ের তাঁর অনেক বন্ধু-বান্ধবও। তাই দুর্গা, হরিহর, সর্বজয়ার মৃত্যুতে যতটা দুখী হই ঠিক ততটাই কিম্বা আরো বেশি মন কেঁদে ওঠে নীতার জন্য। আচ্ছা এবার একটু ভেবে দেখুন তো এই ছবি গুলোতে ভিলেন কে? কার জন্য এই চরম দুর্ভোগ মানুষ গুলোর? কেন দুর্গাকে বিনা চিকিতসায় মরতে হয়? কেন নীতা ফিরে আসতে পারে না তার বাড়িতে, সাধের সংসারে। দারিদ্র্য তার স্ব-লালিত সংকেত নিয়ে এই ছবি গুলোতে অবস্থান করে।
এতগুলো কথা, তার এত বাক্য বিন্যাস দরকার হয়ে পড়লো নানা কারণে। এই মুহূর্তে একটা ছবি নিয়ে তোলপাড় হল কিছু দিন। তার রেশ কাটতে না কাটতেই নির্বাচন এসে পড়লো ঘাড়ের ওপর। তখন বিষয়টা আরো জটিল হয়ে উঠলো। ভারতের তথাকথিত দারিদ্র দেখানো নিয়ে স্লামডগ মিলিওনেয়ারকে কিছু লোক সমর্থন করলেন…কিছু লোক বিরোধিতা। কেউ বললেন বিদেশের চোখে ভারত আর বিদেশীর কৃপায় পুরষ্কার দুটোই প্রায় সমার্থক। আবার কেউ তর্কে মাতলেন হিন্দি ছবির হলিউডি ভার্সন না হলিউডি ছবির হিন্দি ভার্সন সেই নিয়েও। ভারতীয় পরিচালক গরিবী দেখালে ভালো আর বিদেশীরা দেখালে খারাপ এমন প্রসঙ্গও শোনা গেলো কোন এক জাতীয় টেলিভিশন চ্যানেলে। তারা ঋত্বিক, সত্যজিতের সঙ্গে মিশিয়ে দিলেন স্লামডগকে। বিস্মিত হলাম আমরা…বিস্মৃতও। যখন কোনো জাতির সামনের পথটা অজানা আর পিছনের পথটা বিস্মৃত…আমরা কি গোলক ধাঁধায়? আমাদের মজ্জার অন্তরে অন্তরে প্রবেশ করেছে কি সেই কঠোর কঠিন উক্তি …যে জাতি যুদ্ধ দেখে নাই…দাঙ্গা দেখে নাই…মন্বন্তর দেখে নাই…এক নিরালম্ব বায়ু ভূতের মত তার অবস্থান।
ছবিটি দারিদ্র ও তার উন্মোচনের ছবি, হলিউডি না বলিউডি, প্রাচ্য না পাশ্চাত্ত্য এই নিয়ে খুব কঠিন প্রশ্ন তোলে না, ভাব দেখায় সে যেন ভাবাচ্ছেও না। কিন্তু ছবির দেহে তার চিহ্ন গুলো থেকে যায়। এদের সযত্নে লালিত করা হয়। তাই যখন জামাল ব্রিটিশ একসেন্টে ইংরাজীতে কথা বলে তখন আমাদের তেমন কোনো অসুবিধে হয় কি? আসলে প্রথম থেকে জামালকে পৃথক করা হয়েছে। ইচ্ছাপূরণের রাজনীতিটা তার ঘাড়ে চাপানো। সদ্য যৌবনের এক ইনোসেন্ট মুখ ভারতের আজ খুব প্রয়োজন। যাকে খুব সহজেই বলা যাবে, “জামাল, খুদা তুমহারি”…তোমাকেই একা বইতে হবে তোমার দায়িত্ব…তোমার পথের দিশারি তুমিই। সব কিছু না পাওয়ার এই রাগ তোমাকে এগিয়ে দিচ্ছে সাইনিং ইন্ডিয়ার দিকে। যে ইন্ডিয়া তোমাকে খাদ্য, বস্ত্র, বাসস্থানের আশ্বাস দেয়নি বরং তার পরিবর্তে তোমার কপালে এঁটে দিয়েছে আম আদমির তকমা। তোমাকে কাজ দিতে পারেনি কিন্তু দিয়েছে জীবন নিয়ে জুয়া খেলার আশ্বাস। স্বপ্ন দেখিয়েছে প্রতিটি ম্যাজিক মোড়ের জন্য উন্মুখ হয়ে থাকার। যেখানে অপেক্ষা করছে সোনালী স্বপ্নের ভোর অথবা অযাচিত মৃত্যু।
এইসব প্রশ্ন যখন মনের মাঝে পাক খায়, ছবিটির পাঠে নানা পরম্পরায় ধরা পড়ে ওদের আর আমাদের বিভাজনের চিহ্ন ঠিক তখনই দেখি লোকসভা নির্বাচনে কোন পার্টির প্রচার নির্বাহী হিসেবে কাজ করছে ছবিটি। গানের কপিরাইট প্রচুর টাকায় কেনা হয়েছে আম আদমি কে সাথ থাকার জন্য। এটা এমনটা নয় যে এই প্রথম কোনো ছবি প্রচারের কাজে ব্যবহৃত হলো, উপমহাদেশ দেখলো নতুন কিছু। আসলে যেটা ঘটে গেলো মানে অবধারিত ভাবে ঘটানো হল- এই পুঞ্জীভূত দৃশ্যের রাজনৈতিক বানিজ্যায়ণ। তৃতীয় বিশ্বের ধুঁকতে থাকা, উন্নয়নের পথে অগ্রসর হওয়া এক দেশের নির্বাচনী ইস্তাহারের ছাপ পড়লো জামালের স্বপ্নে। প্রেসিডেন্ট ওবামা যেন উঠে দাঁড়িয়ে তাঁর স্বপ্নের ভাষণে বললেন দিন পরিবর্তনের পালা শুরু…নতুন স্বপ্নের ইচ্ছাপূরণের ডানায় ভর করে আগামীর পথ হাঁটো।
এটা কোন পথ?
এটা সেই পথ যে পথে কোনো এক তরুণ আর তরুণী তাদের স্বপ্নকে খুঁজে পাবে রাষ্ট্রের ঠিক করে দেওয়া তার নির্ধারিত পশ্রয়াতিত গ্যাম্বলিং শোতে।
হাঁটতে হাঁটতে পা ধরে আসে থমকে দাঁড়াই শ্যামবাজারের চার মাথার মোড়ে। দেখি বামপন্থী নেতার নির্বাচনী হোর্ডিং-এ জ্বলজ্বল করছে জয় হো’র পরিচিত অক্ষরমালা। ডান এবং বামের একই প্রলোভোন দেখে গুলিয়ে যায় পুরো ব্যাপারটা। পরে শুনেছি সেই হোর্ডিং নামানো হয়েছে এবং হোর্ডিং টাঙানো নিয়ে বিস্তর জল ঘোলাও হয়েছে। কিন্তু সে তো অন্য কথা একটা ছবি পাঠের অন্দরে সাব প্লটের ঠিকানা। ততদিনে অপর দল তারস্বরে জয় হো’র রিমেক প্রচার সঙ্গীত চালাচ্ছে বাংলা সহ বিভিন্ন ভাষায়…বিভিন্ন রেডিও এবং টেলিভিশন চ্যানেলে। আম আদমির এমন উতকৃষ্ট জনপ্রিয় প্রতিরূপ হয়তো অনেকদিন পরে পেলো কংগ্রেস।
সেদিন অস্কারের সকালেও চিত্রনাট্যের তেমন হেরফের দেখা গেল না। সাইনিং ইন্ডিয়া ঝলকে উঠলো প্রতিটি টিভি চ্যানেলে। দেখলাম ঝলমলে পোষাকে নিজেদেরকে ঢেকে ধারাভির নবীন প্রজন্ম রেড কার্পেটের ওপর দিয়ে হাঁটছে। ঘিরে ধরছে টিভি ক্যামেরা, বার বার জিজ্ঞেস করা হচ্ছে কেমন লাগছে তোমাদের ? কি মনে হচ্ছে তোমাদের? ঠিক তখনই আবার দেখতে পাচ্ছি সেই ঘিঞ্জি বস্তি। সাংবাদিক ক্যামেরার সামনে বলে চলেছেন কেউ নাকি কাজে বেরোয়নি… ছবির অভিনেতাদের ঘরে দেওয়া হয়েছে এল সি ডি টিভি। সেখানে উতসুক অসংখ্য চোখ (ঠিক যেমনটা ছিল মূল ছবিতে) তাদের মা, বাবা। এক-এক বার ছেলে মেয়েদের দেখতে পাচ্ছেন আর আনন্দে আত্মহারা হচ্ছেন। সবচেয়ে বিস্ময়ে তাকিয়ে আছে পিঙ্কির মা। অস্কারে তার মেয়েকে নিয়ে নির্মিত তথ্যচিত্র (Smile Pinki) ঠাঁই পেয়েছে। ভোরবেলা গ্রাম থেকে বেরিয়ে অনেক দূরের গ্রামে তাঁকে আসতে হয়েছে টিভি দেখার জন্য। নিজের গ্রাম শুধু নয় আশেপাশের কোনো গ্রামে বিদ্যুত নেই। সাংবাদিক প্রশ্ন করছেন আর পিঙ্কির মা অবাক হয়ে তাকিয়ে আছেন ক্যামেরার দিকে। চকিতে ক্যামেরা ফিরে যাচ্ছে অস্কারের অনুষ্ঠানে আমরা দেখছি পিঙ্কিকে। এক-একটা পুরষ্কার ঘোষণা হচ্ছে আর আনন্দে ফেটে পড়ছে আমার দেশ…আমার ভারত।
আমিও তো ঘুমচোখে উঠে টিভির সামনে…অনেক ভারতীয়ের মতো প্রতীক্ষায় কোনো একটা ম্যাজিক ঘটে যাওয়ার। আমি প্রতীক্ষায় স্বপ্ন পূরণের…
প্রতীক্ষায় বলতে পারার, জয় হোক…।
কিন্তু কার জয়?
কিসের জয়?
সকালবেলায় বন্ধু ফোন করে বললো ” আউট সোর্সিং কিন্তু বন্ধ…ডলারের গন্ধ এখন অনেকেই আর শুকতে পাবেন না…অতএব অস্কার নিয়ে ভুলে থাকো।” কাগজের পাতা ওল্টালাম চোখের সামনে ভেসে উঠলো শুধু আমার রাজ্যেই গরীবের চেয়ে গরীব গ্রামের সংখ্যা চার হাজারেরও বেশি। পনেরো লক্ষ পঁয়তাল্লিশ হাজার চারশো তিয়াত্তরটা পরিবার একবেলা মাত্র খেতে পায়। এক বেলার অন্ন সংস্থান নিশ্চিত নয় এমন পরিবারের সংখ্যা চার লক্ষ আশি হাজার দুশো চল্লিশটি। এইসব যখন আমার মাথায় ঢুকিয়ে দেওয়া হচ্ছে আর আমি প্রাণপণে সরিয়ে দিচ্ছি আমার যুক্তিগ্রাহ্যতাকে, আমি এক মোহের মধ্যে আচ্ছন্ন থাকতে চাইছি। কারণ অনেক দিন আমরা সত্যিই কিছু পাই নি। আমাদের অবলম্বনটাও বড় ফস্কা গেরোর মতো হয়ে গেছে। আর এখনি তো দরকার আমার কাছে একটা ম্যাজিক মোড়ের… একটা গ্যাম্বলিং এর…একটা অবলম্বনের। এর কিছুক্ষণ পরেই রহমান গাইবেন জয় হো…। অস্কারে শুনতে পাবো প্রিয় লেখক গুলজারের নাম। দেখতে পাবো গোটা স্লামডগ টিমের ম্যাজিক চেঞ্জ।
আর ঠিক এর লক্ষ যোজন মাইল দূরে পিঙ্কির গ্রামে বিস্ফারিত নিউজ ক্যামেরার সামনে দাঁড়িয়ে থাকবে হতভম্ব পিঙ্কির মা। কিছু বলতে পারার,না পারার এক উতকন্ঠায় যিনি আচ্ছন্ন। তিনি হয়তো বুঝতেও পারছেন না তাকে নিয়ে শুরু হয়েছে এক লুকোচুরি খেলা।
যে খেলায় মিডিয়া সিদ্ধহস্ত।
যে খেলার মোহে পড়ে জামাল।
যে খেলা দেখায় সাইনিং ইন্ডিয়া।
যে খেলায় অংশ নেয় নির্বাচনী ইস্তাহার।
অংশ নেয় আম আদমির ভারত।
একবার অনুষ্ঠান মঞ্চে…একবার বিরতিতে… সাইনিং ইন্ডিয়ার ঝলকে… ঠিক তার পরেই ভারতের প্রত্যন্ত গ্রামে…সেখানে অপেক্ষারত আত্মীয়রা…ক্যামেরার চকিত চলন। আবার আমাদের সামনে একটা সফল চিত্রনাট্যের রূপায়ণ। এই রকমের দ্রুত গতি আর বিষয় থেকে বিষয়ান্তরে যাওয়ার চিত্ররূপ আমরা দেখেছি স্লামডগে।
আমরা মুগ্ধ।
আমরা মুগ্ধ যখন রহমান বলেন আমার সাথে মা আছেন…আমি বরাবরই ভালোবাসার পক্ষে…। বুকের কাছে মুষ্টিবদ্ধ হাত। রেসুল পুকুট্টি বলেন এক নৈশব্দের মধ্যে শব্দ সৃজনের কথা। বলেন এটা শুধু মাত্র একটা পুরষ্কার নয়…এটা ইতিহাসের হস্তান্তর।
আমরা এই সময়ের সাক্ষী থাকলাম। যার সাক্ষী থাকে আমার ভারত…আমার দেশ। তাকে থাকতেই হয় কারণ সে একটু একটু করে মজতে থাকে রিয়ালিটি শোতে, নির্বাচনী ইস্তাহারের লুকোচুরি খেলায়। জয় হো’র মাদকতায়। আর ঠিক তখনই অন্ধ সুরদাস ভিক্ষে করে রাস্তার ধারে। একশো ডলার এগিয়ে দেয় জামাল। অন্ধ সুরদাস চিনিয়ে দেয় নোটের ওপর থাকা বেঞ্জামিন ফ্রাঙ্কলিং কে, জানিয়ে দেয় লতিকার ঠিকানা। পরে অনেক পরে সে এক প্রশ্নের উত্তরে জিতে নেবে একলক্ষ টাকা। ঠিক সেই সময় তার সঙ্গ দেবে অন্ধ সুরদাস… বেঞ্জামিন ফ্রাঙ্কলিং…আর ফেলে আসা শৈশবের স্মৃতি-যা তাকে হারতে দিচ্ছে না…ভয় পাইয়ে দিচ্ছে না। হু ওয়ান্টস টু বি আ মিলিওনেয়ার শোয়ের আদলে কৌন বনেগা কড়োরপতির ছায়া অনুষ্ঠানে জাঁদরেল ক্যুইজ মাস্টার প্রেম কুমারের (অনিল কাপুর) সামনে জামাল (দেব প্যাটেল) নির্ভিক। জামালকে এই গেম জিততে হবে…না হলে লতিকাকে বার বার ফিরে যেতে হবে স্টেশন থেকে…বারবার ফিরে দেখতে হবে শৈশবকে…ফেলে আসা সময়কে।
গোটা ছবি জুড়ে তাই অতীত আর বর্তমানের দৌড় ঝাঁপ।
গোটা ছবি জুড়ে তাই কয়েকটি প্রশ্ন।
এই কয়েকটি প্রশ্নের ওপর দাঁড়িয়ে আছে জামালের জীবন…তার বেঁচে থাকা…মরতে মরতে বেঁচে যাওয়া সবকিছু। ছবিটাও দাঁড়িয়ে থাকে এই প্রশ্নগুলোর ওপর। তার অনবদ্য আঙ্গিক, গল্প বলার কৌশল, চকিতে এক দৃশ্য থেকে অন্য দৃশ্যে উত্তরণের যে সম্পাদকীয় পন্থা তা দেখার মত…ভালোলাগার মতো।
ছবির শুরু, জামাল পুলিশ কাস্টডিতে। সেখানে তার ওপর টর্চার চলছে। পুলিশ জানতে চাইছে একজন চাওয়ালা, বস্তিবাসী, অশিক্ষত জামাল কী করে উত্তর দিয়ে দিচ্ছে সব কিছুর। তাহলে এর পেছনে কি কোনো রহস্য আছে? তাকে বেদম পেটানো হয়, ইলেকট্রিকের শক দেওয়া হয়…বসিয়ে রাখা হয় অনেকক্ষণ। তার সামনে চালিয়ে দেওয়া হয় সেই শো এর ভিডিও ক্যাসেট। জামাল ফিরতে থাকে তার অতীতে…তার গল্পে। আমরা দর্শকরা পুলিশের সাথেই তার গল্প শুনি।
একদিকে বইতে থাকে জামাল, আমির আর লতিকার গল্প। অন্য দিকে প্রেম কুমারের শো। যেখানে প্রেম কুমার নিজে মেনে নিতে পারছে না জামালের এই অবিশাস্য জিতে যাওয়া। আর একদিকে থানাতে, যেখানে বসে তার জীবনকে ফিরে দেখছে জামাল। তিন দিক দিয়ে এগোতে থাকে ছবির গল্প এগোতে থাকে প্লট…সাব প্লট অনেক কিছু। এগোতে থাকে জামালের লতিকাকে খুঁজে পাওয়ার এক সুন্দর জার্নি।
কি দেখে জামাল গোটা ছবিটা জুড়ে?
জামাল দেখে জীবন বড় অসহনীয়…জীবন বড় প্রতারক। সেটা রান ওয়েতে পুলিশের তাড়াই হোক কিম্বা দাঙ্গাতে নিজের মায়ের মৃত্যু। অমিতাভ বচ্চনের অটোগ্রাফ সংগ্রহ কিম্বা জীবনের ঝুঁকি নিয়ে খাবার চুরী। প্রেম কুমারের শোতে জিতে যাওয়া কিম্বা পুলিশ কাস্টডিতে অত্যাচার। কলসেণ্টারের চা ওয়ালা কিম্বা লতিকার খোঁজ… সব জায়গায় তার ভারত দোমড়ানো-মোচড়ানো। তার মধ্যেই জামালের এগিয়ে যাওয়া। তার খোঁজ ছোটবেলার এক টুকরো স্মৃতি- লতিকা। রেল স্টেশন, বস্তি, তাজমহল, নিষিদ্ধ পল্লী, মুম্বাইয়ের অন্ধকার অপরাধ জগতের আনাচ-কানাচ, টেলিভিশনের রিয়ালিটি শো, থানা এইসব জায়গায় ঘুরে বেড়ায় ক্যামেরা। ঘুরে বেড়ায় জামাল।
১৯৮৮ সালে মীরা নায়ারের সালাম বম্বে ছবির নায়ক, রাস্তার সেই ছেলেটা বড় একা হয়ে পড়ে ছবির শেষে। পাঁচশো টাকা তার আর জমানো হয়ে ওঠে না। ফিরতে পারে না সে দেশে। তার বান্ধবীকেও সে হারিয়ে ফেলে। গণেশ বিসর্জনের উতসবে সে ব্রাত্য। সবাই যখন আনন্দে মশগুল তখন ছবির শেষ দৃশ্যে সে একেবারে একা। পকেট থেকে বার করে লাট্টু। কোথাও ফিরে পেতে চায় তার হারানো শৈশব…তার নষ্ট শৈশবকে। তার ফেলে আসা সময়কে। সেখানে এক অন্য বম্বের চেহারা। সেই বম্বে তখোনো মুম্বাই হয়নি। সালাম বম্বের নায়ক আর যাই হোক জামালের মতো হিন্দু মুসলমানের দাঙ্গা দেখেনা। এক রাজ্য থেকে অন্য রাজ্যে ছুটে বেড়ায় না। জামালের মতো ছবির শেষে কোনো ম্যাজিক চমক তার জীবনে অপেক্ষা করে না। জামাল বরং প্রানপণে চেষ্টা করতে থাকে সহজ ভাবে বাঁচার। দাদা আমিরের মতো অন্ধকার জগতের লোক হতে চায় না সে। রাম বলতে সে বোঝে দাঙ্গা, সুরদাসকে মনে করতে গিয়ে দেখে তার বন্ধুদের চোখ গেলে দেবার ঘটনা। অশোকচক্রের ঘটনার উল্লেখে সে উলটে পুলিশ অফিসারকে জিজ্ঞেস করে ফুচকার দাম কত? জানতে চায় গত পরশু সবার সামনে থেকে কে সাইকেল চুরী করলো?
Slum dog Millionaire ছবিটা শেষ হয় একটা ফ্যান্টাসীর মতো। কোনো এক জয়গাথা গাওয়া হয় যেন। এই জয় গাথা আমার ভারতের…আমার দেশের…যে দেশে জামালের মতো ছেলেরা থাকে। যে দেশে লতিকা নাম সার্চ দিলে কম্পিউটার হাজার খানেক লতিকাকে সামনে এনে দেয়। যে দেশের ছেলেমেয়েরা পারে এই দুঃসহ দারিদ্রকে মাথা পেতে নিতে আর তার জোয়াল টানতে। দারিদ্রকে মহান করে দেখার কিছু নয়। বরং দারিদ্রের দৃশ্যগত কোড গুলোকে আবার নতুন করে পড়া। বারবার ফিরে ফিরে দেখা। আর সেই দেখার অন্তরালে থেকে যায় এক দৃশ্যায়ণের রাজনীতি যে রাজনীতির অন্তরালে বিরাজ করে নির্বাচনী বিজ্ঞপ্তি…ইস্তাহার।
আমাদের আম আদমির সাইনিং ইন্ডিয়া স্বপ্ন দেখায়।
আমি স্বপ্ন দেখি।
হয়তো আপনিও…।
জয় হো…।