দিনের আলো নিভে যাওয়ার পর রাস্তার বাতিগুলো জ্বলতে আরম্ভ করে। প্রথম হেমন্তের দিনগুলোতে ঠিক এই সময়ে পাতলা কুয়াশার চাঁদরে ঢেকে যায় ভিআইপি রোডের এই অংশটি। রাস্তার দু পাশে সারি বেধে দাড়িয়ে আছে বাগান বিলাশের ঝোপগুলো। বাহারি রঙের ফুটতে শুরু করা ফুলগুলো কুয়াশার প্রলেপে আরো সতেজ হয়ে উঠছে। রাস্তার শেষ প্রান্তের বাড়িটির কোণ ঘেষে দাড়িয়ে থাকা লাইটপোস্টটি অন্যদের তুলণায় বেশি আলো ছড়ায় । যার আলো খানিকটা ছিটকে পড়ে বড়িটির দোতলাস্থিত বৈঠকখানায়। বৈঠকখানার দরজা-জানালা সবসময় খোলা না থাকলেও বিশেষ অতিথিদের আগমনে খুলে দেওয়া হয় – সতেজ অম্লজানে গভীর শ্বাস নিতে। কংক্রীটের বস্তিগুলোয় অফিস-মিটিং-সিটিং করে অতিথিরা ক্লান্ত হয়ে পড়লে এখানে আসতে চান। বাড়ির কর্তার আমন্ত্রণ পেতে তাই মরিয়া হয়ে উঠেন অনেকেই। দিবানিশি দেয়া নেয়ার খেলা চলে বাড়িটিতে।
কী চলবে বলুনতো! রাশান ভডকা না অন্য কিছু? ওহ! সরি, আপনার সাথে রাশান ভডকা না গেলেও জার্মান বিয়ার যাবে নিশ্চয়ই? কর্তা বললেন।
আলো-আধাঁরিময় বৈঠকখানায় পাতানো সোফায় জানালার ফোকর গলে লাইটপোস্টের আলো ঠিকরে পড়ে। কর্তার কথা শুনে অতিথি মুচকি হাসেন। বলেন, আপনার নেকনজরে যখন পড়েছি, তখন সবই চলবে। বাংলা চোলাই দিয়ে শুরু করেছিলাম স্যার, আপনাদের দয়া-দোয়া পেলে রাশানও সইবে।
কর্তা হাত তুলে আশীর্বাদ দেন। সুঁই হয়ে ঢোকা আর ফাল হয়ে বেরুনোর মাযেজা বোঝেনতো? এ বিষয়ে আপনি আমাকে বা আমার এলাকার লোকদের গুরু মানতে পারেন। আমরা বরাবরই এ ব্যপারে সিদ্ধহস্ত। এ এক উর্বর ভূখন্ড! কত সহজে সুঁই ফালে পরিণত হয়। দেখতেই তো পাচ্ছেন, সমাজে কী সম্মান! কী দাপট! মসজিদে যখন সবার শেষে যাই, মুসুল্লিরা সম্মানের সাথে জায়গা ছেড়ে দিয়ে আগের কাতারে পৌছে দেয়। যে কোন সামাজিক অনুষ্টানে আমরাইতো মধ্যমণি। এই কী শেষ! শেষ নয়। এই আসন পাকাপোক্ত করে যেতে হবে সন্তান সন্ততির জন্যে। আমাদের পর আসবে ওরা। একবার স্থানচ্যুত হলে ফিরে আসা খুবই কঠিন। কর্তা হাই তুলে আড়মোড়া ভেঙে সোফায় গা এলিয়ে দেন।
অতিথি বলেন, আমরা বোধ হয় রাজতান্ত্রিক গণতন্ত্রের পথে যাচ্ছি। এই মানে বাপের পর ছেলে, ছেলের পর নাতি। আমার চশমাওয়ালা দুটো গাধা আছে। অনেক বুঝাই কিন্তু পথে আসতে চায়না স্যার। অল্পেই যাদের পরম সন্তুষ্টি। সারাদিনই বইপত্র নিয়ে পড়ে থাকে।
বলে কিনা নিজের যোগ্যতা অনুযায়ী কাজ
জোগাড় করে নেবে। গ্লাসে চুমুক দেন অতিথি।
কর্তাও গ্লাসে গ্লাস ঠুকে নিয়ে চুমুক দিয়ে বলেন,বলি কী ! ওদের ভুলিয়ে ভালিয়ে আমেরিকায় পাঠিয়ে দেন। আমিই সব ঠিক করে দেব। আপনাকে আর ফিরে তাকাতে হবেনা। ওদের অল্পে সন্তুষ্টি একেবারে উবে যাবে। তবে খুউব সতর্ক! যেন আবার বিগড়ে না যায়! ওদেরকে একবার আমার কাছে পাঠাবেন কেমন?
জ্বী জ্বী! পাঠাবো। অতিথি আরেকটি চুমুক দেন।
রাত বাড়ার সাথে সাথে লাইটপোস্টের আলোর মাত্রাও বাড়তে থাকে। সেদিকে তাকালেই চোখ ধাঁধিয়ে যায় কর্তার। আলো আধাঁরির খেলায় তাই আলোর প্রাধান্য বাড়ে। অতিথির সেলফোনে বিপ বিপ শব্দ ওঠে।
আজ বাসায় আসতে দেরি হবে-ফোন করে বিরক্ত করবেনা।
শেষ চুমুক দিয়ে কর্তা গ্লাসটি টেবিলে রাখেন। দুধ থেকে মাখন তুলতে গেলে একটু কষ্ট সইতে যে হবেই। যারা সাধারণ মানুষ তারাতো দিন মজুরি করে সঞ্চিত টাকায় বকনা বাছুর কিনবে। অতি যত্নে আর শ্রমে পেলে-পূষে বড় করবে বকনাটিকে। গাভীন হওয়ার কালে ভাল বাছুর পাওয়ার আশায় আমাদের দপ্তর থেকে বিদেশী ষাড়ের বীজ দিয়ে নিষিক্ত করাবে যৌবনবতি বকনাটিকে, অবশ্য প্রয়োজনীয় ফি দিতে হবে, সাথে দ্বিগুণ বা ত্রিগুণ স্পীড মানি, অতঃপর অপেক্ষার পালা শেষে তার গোয়াল ঘর আলো করে আসবে স্বর্গীয় বাছুর। বকনাটি গাভী নাম নিয়ে বইয়ে দেবে দুধের নহর। সেই দুধে শ্রম দিলেই মাখন আসবে। আর আপনার কাছে তো সরাসরি দুধই এসে হাজির হবে, তো মাখন তুলতে কতক্ষণ? লাইটপোস্টের তীর্যক আলো উপেক্ষা করে বারান্দায় আসেন কর্তা। অতিথিও পেছনে এসে হাজির। আপনি আমার গুরু স্যার। আমি আপনার মুরিদ।
কর্তা হাসেন নিঃশব্দে। আমার মুরিদ না হয়ে আমার পীরের মুরিদ হন। তখন আমরা দুজন হব পীর ভাই। আপনার জন্য থাকবে বিশেষ ব্যবস্থা। ভিআইপি মুরিদ তো! তাই। আগামী বৃহস্পতিবার রাতে আমার সাথে আপনাকে নিয়ে যাব। এডমিশন ফি টা কত হতে পারে জানিয়ে দেব সময়মত। ভিআইপি মুরিদ-ভিআইপি দোয়া-ভিআইপি ট্রিটমেন্ট! ও হ্যা! আরো একটা কাজ করতে হবে। আমার জ্যোতিষীর সাথে আপনাকে দেখা করিয়ে দেব। সে আপনাকে প্রয়োজনীয় পাথর বটিকা দিয়ে আপনার সীমানা প্রাচীরে শক্ত দূর্গ গড়ে তুলবে। কোন অপশক্তি আপনাকে ছুঁতেই পারবেনা। লাইটপোস্টের দিকে তাকান কর্তা। অতিথিও তাকান। আমি তাহলে আপনার ডাকের অপেক্ষায় থাকলাম।
লাইটপোস্টের আলোর প্রখরতা আরো বাড়ে। চোখে লাগে। কর্তা তাকাতে পারেন না। আচ্ছা রাত বাড়ার সাথে সাথে এই পোস্টের বাতিটি উজ্জ্বল থেকে উজ্জ্বলতর হতে থাকে। মনে হয় যেন বাতিটি এক্ষুণি ফিউজ হয়ে যাবে। কিন্তু হয়না।
অতিথি বলেন, তাই নাকি স্যার! একদা আমার তত্ত্বাবধানেইতো এই বাড়িটি আপনাদের জন্য তৈরী হয়েছিল। নিরাপত্তাজনিত কারণেই এই পোস্টটি এখানে বসানো হয়েছিল। ডিজাইন করার সময় অনেক খাটুনি হয়েছিল আমার। ভেতরেতো নিরাপত্তা আছেই। বাইরে নিরাপত্তারক্ষীরা একটা বলয় তৈরী করে রেখেছে। তবে লাইটপোস্টটি নিয়ে একটা ছিচকে ঘটনা ঘটেছিল। কর্তা চমকে উঠেন। তাই নাকি!
অতিথি বলেন, হ্যা স্যার, বিদ্যুৎ বিভাগের মাস্টার রোলের একজন কর্মী খুঁটি বেয়ে মাথায় উঠে বৈদ্যুতিক সংযোগ দেয়ার মুহূর্তেই বিদ্যুৎপৃষ্ট হয়ে মারা যায়। ওখানেই সে ঝুলছিল পুলিশ আসার আগ পর্যন্ত। মাস্টার রোলে ছিল বলে ওর পরিবার কোন ক্ষতিপূরণ পায়নি। ঐ যে কী একটা বস্তাপঁচা স্লোগান আছে না, দুনিয়ার মজদূর এক হও! এক হও! শ্রমিক সভাগুলোতে সেই সবার আগে কাশনটি তুলত বলে জেনেছি।
তাই নাকি! কর্তা উৎকন্ঠিত স্বরে বললেন। ভাববার বিষয় তো! পীর সাহেবের সাথে কনসাল্ট করতে বৃহস্পতিবার পর্যন্ত অপেক্ষা করতে হবে। উনার কোন ফোন নেই যে এক্ষুণি তাঁকে জানাবো। তাছাড়া এখানে তিনি সরাসরি আসবেনও না। অতিথি বলেন, কেন? এখানে আসতে তাঁর সমস্যা কী? জানতে পারি কি স্যার? কর্তা গম্ভীর স্বরে বলেন, এটা খুবই রহস্যময়। আমরাতো সবসময় বিতর্কের কেন্দ্রবিন্দুতে থাকতে পছন্দ করি। উনারা তা চান না। মিডিয়ার যুগে উনি একেবারে মিডিয়া বিমূখ। উনার দরবারে কেউ কোন ইলেক্ট্রনিক্স সামগ্রী নিয়ে ঢুকতে পারেনা। এ গুলো নিষিদ্ধ সেখানে। আসলে জগৎ সংসার বড়ই রহস্যময়। আমরা তার কতটুকুইবা বুঝি। উনারা বুঝেন বলেই উনাদের পরামর্শ নেবার চেষ্টা করি। দেখছেন না কত ঘটনা তিল থেকে তালে হয়ে যাচ্ছে। আমরা ঠিক বুঝতে পারিনা, পারলে তো মাথার চুলগুলো আর সাদা হতো না।
বাড়ীর বেয়াড়া বরান্দার টেবিলে গ্রীল করা কবুতর আর শশার পাত্র রেখে নিচে চলে যায়। বাতাশে সুগন্ধ ছড়ায় কবুতরের গ্রীল। বারান্দায় পাতা চেয়ারে বসেন কর্তা এবং অতিথি। আজকের গ্রীলটা ভালোই হবে মনে হচ্ছে। কর্তা অতিথির দিকে প্লেটটি এগিয়ে দেন।
যে সুগন্ধ বেরুচ্ছে তাতে তো তাই মনে হচ্ছে। সব কিছুরই জোগান কমে যাচ্ছে বাজারে। অনেক জিনিষ আজকাল পাওয়াই যায়না।
কর্তা আর অতিথি নিঃশব্দে খেতে থাকেন। এক টুকরো মাংশ আর এক টুকরো শশা। কর্তা লাইটপোষ্টের দিকে তাকান। কিছু একটা নড়েচড়ে উঠে। মুহূর্তের মধ্যে নিঃশব্দে কর্তার মাথায় ঢুকে যায় গুলি। চিৎকার দিয়ে উঠেন কর্তা। অস্ফুট স্বরে বলেন-অনেকগুলো লাইটপোষ্ট আমার দিকে এগিয়ে আসছে!!
আর কথা বলতে পারেন না কর্তা । বাইরে সাইরেন বাজার শব্দ শোনা যায়। অতিথি চোখে অন্ধকার দেখতে থাকেন।।
—————–