বাড়ির সত্ত্ব নিয়ে দুপক্ষের বাগ-বিতন্ডা যখন চরমে; ভোজবাজির মত তৃতীয় পক্ষের উদয় হল। আশ্চর্য ব্যাপার! কিছুদিন আগেও জায়গাটা দিনভর ঝড়ে ভিজে,রোদে শুকিয়ে পাঁপড়ভাজা হত- ভুল করেও কারো দৃষ্টি এ পর্যন্ত পৌঁছায় নি। একরাশ জলে গা ডুবানো সবুজ সবুজ পাহাড়গুলো নিশিদিন বুনো মোষের মত দীর্ঘশ্বাস ছাড়ত তখন। হলদে চামড়ার পাহাড়ীগুলো ছাড়া লোকজনের দেখা মিলত কদাচিৎ। যখন পর্যটন বিভাগের চোখ পড়ল; আরে সর্বনাশ- জায়গাটির উপযোগিতায় স্বয়ং রাষ্ট্রপ্রধান থ্। এমন একটি জায়গা এতদিন কোথায় ছিল! কোন অতলে! -না। আর ফেলে রাখা যায় না। এখানে পর্যটন কেন্দ্র হবে, দেশ-বিদেশের লোক আসবে -লেগে গেল ধুন্দুমার। পাহাড়ের বুক চিড়ে সিঁড়ি, এখানে সেখানে ঝুলন্ত সেতু, প্রমোদ-বিহারী নৌকা -সবকিছু চোখের পলকে। সবার অন্তরালের সবচেয়ে অবহেলিত জায়গাটি কি এক জাদুমন্ত্রে রাতারাতি দেশের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠল। পাহাড় চূড়ার শতভঙ্গ পরিত্যক্ত কুড়েঘররটিও এখানে পূরাকীর্তি, দর্শনীয় বিষয়, রাষ্ট্রীয় সম্পত্তি। প্রতিদিন শত-শত লোক আসে, ঘুরে-ফিরে- চলে যায়। অনেক টাকার ব্যবসা সরকারের (বাইরের লোকদের আরো বেশি)। ব্যবসাটা জিইয়ে রাখতে খাটাখাটনিও প্রচুর; কালোঘাম ছুটে যায় ওদের। – মানুষ নূতনত্বে বিশ্বাসী। নূতন কিছু দরকার ওদের। ওই খুঁজতে খুঁজতে একদিন কারো চোখ চকচক করে উঠল।
একেই বলে পোয়াবারো। এমন জায়গায় কারুকার্যময় কাঠের বাড়ি!
ও তো রাজবাড়ি। দুইশ বছরের পুরানো।
সর্বনাশ! এমন হেরিটেইজ কেউ এভাবে ফেলে রাখে। এভাবে চললে কিছুদিনের মধ্যেই এটা ধ্বংস হয়ে যাবে। এর দ্রুত সংস্কার প্রয়োজন। এখানে মিউজিয়াম হবে। মানুষ আসবে; দেখবে; তাদের ঐতিহ্যকে জানবে –
কিন্তু, বাড়িটাতো পোড়োবাড়ি নয় জনাব। রাজার ছেলে এখনো ওখানে থাকে।
অসম্ভব! এমন ভয়ঙ্কর নির্জনতায় আর যাই হোক, মানুষ থাকতে পারে না।
অতএব, যেদিন লোকটা দেখল আমি বাড়িটাতে আছি এবং বেশ বহাল তরিয়তেই আছি Ñ তার চোখ ছানাবড়া হয়ে উঠেছিল। অনেকদিন পর আমি যেন টসটসে রসগোল্লা দেখলাম। ধাতস্থ হতেও খুব একটা সময় লাগেনি তার (শিক্ষিত লোকগুলো শার্দুল সব)। কথাবার্তায় পটু অতিচালাক লোকটা অনেককিছু বুঝিয়েছিল আমাকে -এটি পাবলিক প্রপার্টি, দেশের ঐতিহ্য; দেশের মানুষের জন্য উন্মুক্ত হবে তা-। মিউজিয়াম হবে এখানে-
আমি কি সেখানে সং সেজে বসে থাকব?
মানে!
আমি কোথায় যাব?
দেখুন, সরকার বাড়ির সমপরিমাণ মূল্য আপনাকে পে করবে –
মানে, বাড়ি আমাকে ছাড়তেই হবে!
আপনি ভুল বুঝবেন না। আমরা বাড়িটি ছিনিয়ে নিতে আসিনি। কিন্তু, একবার ভেবে দেখুন- এভাবে অযতেœ থাকলে আপনার পূর্বপুরুষের রাজকীয় বাড়ি, এন্টিকস- মানে, আপনার বাবা-দাদাদের স্মৃতিচিহ্ন; বাড়ির বহুমূল্য তৈজসপত্র- সব তো নষ্ট হয়ে যাবে। সরকার চাচ্ছে, এই জিনিসগুলো যাতে সর্বোচ্চ যতেœ থাকে-
জিনিসপত্রের কথা বলছেন তো। ওই বেচে বেচে এতদিন পর্যন্ত আমাদের দুজন মানুষের পেট চলেছে। আর কিছু অবশিষ্ট আছে বলে মনে হয় না।
আর ইউ আ ম্যাড! আপনি জানেন, জিনিসগুলোর দাম কত!
খারাপ না। এক একটা জিনিসের দামে সপ্তাহখানেকের খাওয়ার খরচ উঠে আসে।
ওহ্ সিট্। ইউ ডোন্ট নো হোয়াট ইউ হ্যাভ ডান। আপনার বিরুদ্ধে দেশদ্রোহিতার অভিযোগ আনা উচিত।
সে আপনাদের মর্জি। শেষ কথাটা আমি বলে দিচ্ছি; যদি বাড়ি ছাড়ার ইচ্ছে থাকত- তবে, অনেক আগেই আমি ওপারে চলে যেতাম। দিনের পর দিন- খেয়ে, না খেয়ে এই নগ্ন নির্জনে পড়ে থাকতাম না।
কথাটা হয়তো ঠিক। তারপরও, দেশের জন্য- দেশের মানুষের জন্য আপনার মধ্যে সামান্যতম মমত্ববোধও কি নেই?
ঐ জিনিস একসময় প্রচুর ছিল- অঢেল। ছোটবেলায় আমার মাকে ওরা মেরে ফেলল; তাদের জন্য আমার মমত্ববোধ ছিল। সরকার নদীতে বাধ দিল; পাহাড়ী ঢলে ভেসে গেল আমাদের সবকিছু। আমি ভেবেছিলাম ভালই হয়েছে; দেশের লোক হয়তো কিছু পাবে এবার-। ওই দিতে দিতে আমার মমত্ববোধের ভান্ডার নিঃশেষিত প্রায়। আর কিছু দেখাতে পারব না আমি। চাইও না।
তবুও বলছি; ভেবে দেখলে ভাল হয়। একসাথে অনেক অর্থ আপনার হাতে আসবে। আর, এটা তো জানেন- সরকার চাইলে এই বাড়ি সিজ্ করতে পারে।
আপনাদের যা খুশি করতে পারেন। আমি বাড়ি ছাড়ছি না।