চাঁদনি রাত।
মেঘের দল আজ নিয়েছে ছুটি। কাল সকালেও হল্লা করে মেঘের আনা গোনায় যে আকাশটা ছিল গোল্লাছুটের মাঠ, আজ সেই আকাশের-ই অন্য রূপ। যেন নির্জন রাস্তার মত আকাশটা আজ নিরব। সমস্ত আকাশ জুড়ে পূর্ণিমা চাঁদের আলো। অদ্ভুত মায়াবী জোছনা ছড়ানো মাধবী চাঁদ স্নিগ্ধ, কমণীয়। ফুটফুটে জোছনায় উজালা মনে, নদীর তরতরে স্রোতে ডিঙি নৌকো বেয়ে চলেছে ওরা দু’জন।
নৌকোটি মাঝ নদীতে। নদীতে তেমন জোয়ার নেই। নিস্তরঙ্গ নদীপথে এগিয়ে চলেছে নৌকো। নৌকোটির এক প্রান্তে বৈঠা হাতে প্রীতম। আর অন্য প্রান্তে অবণত মস্তকে এলোচুলে পৃথা। দু’জনেই নিরব। কথা নেই মুখে। শুধু থেকে-থেকে নদীর পানিতে বৈঠা দিয়ে পানি সরানোর শব্দ শুনা যাচ্ছে। এ শব্দটির সাথে ডাইনা তবলার সুুর ঠিক করার সময়কার ধ্বণির মিল খুঁজে পেল পৃথা। অদ্ভুত সেই সুর-
তং——-!
তং——-!
দির দির দির দির, তং——-!
দূরে কোথাও কোন কামিনী ফুলের গাছ হতে থেকে-থেকে ভেসে আসা তীব্র আর নেশা জাগানো সুরভী, মদীরা করে তুলছে পৃথাকে। পৃথার মুখের ডান পাশটায় পূর্ণিমার আলো পড়ে তাকে আবছায়া অপ্রী মনে হচ্ছে। মৃদুমন্দ বাতাসে পৃথার লম্বা চুলের ক্ষাণিকটা বাতাসে উড়ছে। টিয়া রঙা তাঁত শাড়ি পরনে পৃথা বসেছে পা দুটোকে সামনে আধ বাড়িয়ে, হাঁটুমুড়ে। খালি পা। পায়ের তলায় লাল টুকটুকে আলতা মাখা। কপালের স্ফটিক টিপটির উপর চাঁদের আলো পড়ে ঝলসে উঠছে কপালের মধ্যভাগ। তন্বয় হয়ে পৃথাকে দেখছে প্রীতম অপলক চোখে। তার দৃষ্টি জুড়ে অপূর্ব অক্ষয়ী মুগ্ধতা!
এবার দু’হাতকে ভাঁজ করে হাঁটুর উপর রেখে, তার উপর থুত্নিটাকে স্থাপন করলো পৃথা। ডান দিকে চোখ আড় করে তাকালো নদীর পানিতে। নৌকোটি দুলছে। পানিতে দুধেল জোছনা ধুয়ে-ধুয়ে মিশে যাচ্ছে। নদীর পানিকেও আজ সাদা মনে হচ্ছে। পানির যতটুকুনে জোছনার আলো পড়েছে, তাকে মনে হচ্ছে দুধের নদী। আর তীরের কাছটা ক্ষানিক অন্ধকার, আবছায়ার মত ধূসর। দূরে কোথাও কীর্ত্তণের আসর বসেছে। মন্দীরার টুং-টাং শব্দ, ঢোলক আর খমকের সুর ভেসে-ভেসে আসছে।
হাল্কা বেগুণী জমিণে গাড় বেগুণী সুতোয় নকঁশী তোলা ফতোয়ায় নিটোল লাগছে প্রীতমকেও। ওর দৃষ্টিতে রাজ্যির স্বপ্ন। যেন রূপকথার রাজকুমার ময়ূরপঙ্খী নায়ে চড়ে রাজকুমারীকে সাথে করে চলছে অজানা দেশের উদ্দেশ্যে।
পৃথা কাত হয়ে ডান হাত বাড়িয়ে নদীর পানিতে ঢেউ দিল। নদীর পানিতে ছায়া পরা পূর্ণিমার আস্ত চাঁদটি হাতের দোলায় ভেঙে-ভেঙে অনেকগুলো কাঁচের টুকরোয় পরিণত হ’লো যেন।
রাতের প্রকৃতির নিঃস্তব্ধতা ভেঙে “ওম” ধ্বণি করে মুচকী হাসলো পৃথা।
প্রীতম জিজ্ঞেস করলোঃ
–“ভাল লাগছে তোমার? ”
–“ভাল লাগবেনা আবার? এত সুন্দর প্রকৃতি! এই মায়াময় জোছনা রাতে আমার সাথে আমার প্রিয় মানুষটি” বলেই পানি ছলকে প্রীতমের অপলক চোখে পলক ফেলালো পৃথা।
–“অমন করে দেখতে নেই।” পৃথা লজ্জা পেল।
–“কেন? দেখতে নেই কেন? অমন করে দেখলে ফুরিয়ে যাবে বুঝি?” মিট-মিট করে হাসলো প্রীতম।
–“না, তা না।”
–“তবে? তবে কি?”
–“জানিনা…” লজ্জায় দু’হাতের তালুতে মুখ লুকালো পৃথা।
পৃথাকে লজ্জা পেতে দেখে দূরের ওই চাঁদ ও স্মীত হাসলো যেন। ওদের নৌকোটি এবার তীর ঘেঁষে এগিয়ে চলেছে।
–“আমাদের কোথায় নামা উচিত? ”
–“কোথাও না।” হাসলো প্রীতম।
–“মানে?” অবাক হলো পৃথা।
–“মানে নেই কোন।” প্রীতমের সামনের দিককার চুলের এক গোছা ঝুলন্ত বারান্দার মত বাতাসে দুলছে। প্রীতম এবার বৈঠা নামিয়ে রেখে সটান শুয়ে পড়লো নৌকোর পাটাতনে।
–“সে কি…..? মাঝি ছাড়া নৌকো চলবে কি করে!” অবাক হয়ে প্রশ্ন করলো পৃথা।
–“দেখ-ই না, কেমন করে চলে! আমি বুঝি শুধুই মাঝি? ” মৃদু অভিমাণ প্রীতমের কন্ঠস্বরে।
–“তবে? তবে কি তুমি?” হি: হি: হি: হি: হাসলো পৃথা।
–“আমি মাঝি? এই আমি দিলাম ঝাপ নদীর জলে।”
–“আরে…..! না- না- না – না- না- না – না- না। নদীতে ঝাপ দিলে যে ডুবে যাবে তুমি। সাঁতার জানো?”
–“সাঁতার জেনেই বা কি হবে? নদীতে ঝাঁপ দেব তো ডুবে মরার জন্যই।” প্রীতমের কন্ঠে অভিমাণের সুুর আরও গাঢ় হ’লো।
–“চলো, তীরে নামি।” পৃথা বল্ল।
–“তীরে নেমে হবে টা কি শুনি? এই জনারণ্যে ভাল লাগে তোমার?”
–“তাহলে আমরা কোথায় থামবো?” পৃথা আরও বেশি চিন্তিত হ’লো যেন।
–“কোথাও না।”
–“কোথাও না !?! কি বল তুমি?”
–“হ্যাঁ, কোথাও না। আমরা থামবো না। আমরা শুধুই বয়ে যাব। অনন্তকাল ধরে বয়ে যাব এ দৃশ্যকে সাথে করে।”
–“এভাবে কি জীবন চলবে? পৃথা বাস্তবে ফিরে এল যেন।
–“মানুষের চাহিদা তো অনেক কিছু, তা পূরণ ও তো করতে হয়। অন্ন, বস্ত্র……. এসব লাগবে না?”
–“হ্যাঁ লাগবে। সব ই করবো আমরা; তবে আমাদের আজকের এ দৃশ্যকে ছাপিয়ে নয়। আমাদের জীবন চলার পথে আমরা বয়ে যাব আজকের রাতের এ দৃশ্যের মত বহতা হয়ে। তুমি আমার সাথী হয়ে থাকবে এমনি স্নিগ্ধতা নিয়ে আজীবন। সেখানে যেন কখনও ছন্দের পতন না হয়, যেন সুর ভ্রষ্ট হয়ে বেসুরো না বাজে, যেন স্বপ্নের না হয় স্খলণ।”
আজলা ভরে নদীর ঠান্ডা পানি প্রীতমের পায়ের তলায় তির-তির করে গড়িয়ে দিল পৃথা। চনমণিয়ে উঠলো প্রীতমের সমস্ত স্নায়ু চাঞ্চল্যয়। অস্ফুটস্বরে প্রীতম শব্দ করে উঠলো ‘অওফ’!
এবার সটান হয়ে শুয়ে থাকা প্রীতম উঠে বসলো। ফতোয়ার মাঝ বুকের চিরল ফাঁকে আড়াল করে রাখা সাদা গন্ধরাজ ফুলটি বের করে প্রীতম এগিয়ে এল পৃথার কাছে। পৃথা তার এলোচুল বিন্যস্ত করলো খোঁপায়। পৃথার এলো-খোঁপার এক কোনে প্রীতম গেঁথে দিল অনন্ত সৌরভ – জীবনের পরিপূর্ণ ঠিকানা।