মোহাম্মাদ আব্দুলহাক
(আমার সবগুলো লেখার কপিরাইট আছে)
পুষ্প সুবাসে সুবাসিত বসন্ত-বাতাস লীলাচঞ্চল হয়ে নৈর্সগে সঞ্চালন হচ্ছিল সায়ংকালে ফুলবাগিচায় এসে ফুলের পানে তাকিয়ে সরসীর হাস্যোজ্জ্বল মুখ বেদনাচ্ছন্ন হয়েছিল। আজ ওর জন্মদিন। দোলকেদারায় বসে টেবিলফ্যান চালিয়ে বিচিত্রা পড়াকালে ক্যাবড্রাইভার একটা গোলাপ দিয়ে গিয়েছিল। ফুলের পানে তাকিয়ে সুবাস শুকে সরসী বুঝতে পেরেছিল, সদ্য তোলা দ্বিরঙ্গী গোলাপটা বিশিষ্ট এবং অসাধারণ। পুষ্পিত হয়নি কলি ফুলের মাঝামাঝি। সর্তকতার সাথে ডোরে বেঁধে ফুলটা গলায় ঝুলিয়েছে। কিন্তু কেন প্রশ্নের জবাব যখন আমি খোঁজছিলাম। তখন এক ফোঁটা চোখের পানি কপোল বেয়ে গোলাপের উপর পড়েছিল। কান্নাবিন্দু ঝরার শব্দ আমার কানে বজ্রধ্বনির মত হয়েছিল। চমকে তাকিয়ে দেখি দু হাতে মুখ লুকিয়ে সরসী ডুকরে কাঁদছে। সান্ত্বনাবাণী শুনিয়ে ওকে সান্ত্বনা দেবার জন্য আমি লঘুপায়ে হেঁটে নিকটবর্তি হতেই, ডান হাতে অশ্রু মুছে ফুল গাছের উপর হাত বুলিয়ে আস্তেধীরে হাঁটতে শুরু করল। আমি হাত প্রসারিত করে নাম ধরে ডাকতে চেয়ে আশ্চর্যাম্ভিত হয়ে থমকে দাঁড়িয়ে কান পাতলাম। এমনসময় লীলাচঞ্চল বাতাস বিচঞ্চল হয়ে বেগে বইতে লাগল। শিউলি বকুল হাসনোহানা ঝরে পড়ছে দেখে সরসী গুনগুন করে বলছে,
পুষ্পোউতসব পুষ্পোদ্যানে পুষ্পবৃষ্টি ঝরছে,
কন্ঠলগ্নে পুষ্পাঞ্জলি দেব বনফুলে মধু জমেছে।
প্রাণান্তকর পরিতাপ ভুলে মন প্রাণবন্ত হতে চাইছে,
প্রিয়তম,
পুষ্পশয়ন করব লতাবিতানে পুষ্পশয্যা পাতা আছে।
সরসীর কবিতা শুনে আমি সাতপাঁচ ভেবে চিন্তাক্লিষ্ট হয়ে কল্পপুরে প্রবেশ করে আলেয়ার আলোতে পথ দেখে কল্পনাবিলাসে হাঁটতে শুরু করলাম। উদাস নয়নে এদিক ওদিক তাকিয়ে হাঁটছি। ফাগুন আগুন জ্বেলেছে নৈসর্গে বসন্ত। বাতাসে পুষ্পসুবাস। চোখ বোঁজে বুক ভরে শ্বাস টেনে দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে, আস্তেধীরে চোখ মেলে সামনে তাকিয়ে দেখি কল্পবৃক্ষে হেলান দিয়ে এক যুবক বসে আছে। মন্থরগতিতে হেঁটে তার নিকটবর্তি হলাম। আমার উপস্থিতি অনুভব করে ধীরে ধীরে চোখে মেলে মৃদুহেসে সালাম করে জিজ্ঞেস করল, ‘এখানে এলেন কেমন করে’?
‘তোমার খোঁজে’। আমি জবাব দিলাম।
‘নিশ্চই সরসীর সাথে দেখা হয়েছে’?
‘হ্যাঁ’।
‘ও কাঁদছিল, তাইনা’?
‘হ্যাঁ’।
‘দুধে আলতা সাদা গোলাপটা ওর গলায় ঝুলানো ছিল, তাইনা’?
‘হ্যাঁ’।
‘আমাকে খোঁজছেন কেন’?
‘জানতে চাই, সরসী কাঁদছিল কেন’?
‘অর্ধচন্দ্র দেখিয়ে আমাকে অপমান করেছিল’? বলে যুবক হাতে ভর দিয়ে দাঁড়িয়ে, হাতে হাত ঝেড়ে আমার মুখের পানে তাকিয়ে ম্লান হেসে বলল, ‘আমিও আপনার জন্য অপেক্ষা করছিলাম’।
‘বললে নাম জানব’।
‘অনীহ’। ছোট্ট করে বলে মাথা দুলিয়ে জিনসের পকেটে হাত রাখতে রাখতে বলল, ‘দোদুল্যমান মন দোনোমনো করছে’।
‘আগপিছ করে এগুতে পারবেনা’। বলে তার পানে তাকিয়ে তাকে গুনগুনাতে দেখে মৃদু হেসে বললাম, ‘জলাশয়ের জলে তাকিয়ে গুনগুন করে আকাশের তারা গুণে তুমি ধনীও হতে পারবেনা’।
‘ব্যাঙের আধুলি দিয়ে ধনমদ কিনে অর্থপিপাসা মেটাতে চাইনা আমি জানি সময় থেমে থাকেনা’।
‘জানি সময় হল জীবনের মাপ এবং গতি। কিন্তু বেজুত হলে গতি বেগতিক হয় এবং বেগনিপাড়ের আলোকে কখনই জুতসই করা যায়না’।
‘জানি লালউজানি আলো দেখলে চোখে ধান্দা লাগে। তাই আমি কালো চশমা পরি’। বলে ডান হাতে বাম চোখের পানি মুছে বাম হাতে চশমা পরে, ঘাড় বাঁকিয়ে আমার পানে তাকিয়ে ঠোঁট বাঁকিয়ে বিশারদের মত হেসে বলল, ‘আজ ওর জন্মদিন ছিল। তাই ফুলটা পাঠিয়েছিলাম’।
‘Spiritless you are a heartless, aren’t you’? ‘Yes, lovelorn I’m loveless’.
‘হে হৃদয়হীন, এখন কোথায় যাবে’? আমি টিটকারি করে বললাম।
‘কলজেটা বার করে দেখ, আমার হৃদয়টা জ্বলে আলাত হচ্ছে’। বলে বুকের বাম পাশে ডান হাত বুলাতে বুলাতে বলল, ‘অনেক কাঠখড় পুড়িয়ে আমি আশাদীপ জ্বালিয়েছিলাম। কিন্তু ছুমন্তর পড়ে এক ফুঁকে আশাদীপ নিভিয়ে পাষাণী আমার স্বপ্নাকাশ অন্ধকার করেছে’।
‘কি হয়েছে, আমাকে বল’?
‘ও আমার বাল্যপ্রেম কখনো ভুলা যায়না। তাই বেহায়ার মত বার বার ফিরে যেতাম আমি এখন ওকে ভুলতে চাই বাহুতে প্রেয়সী কখনো হৃদয়হীনা হয়না জানি আমার প্রিয়তমা প্রেমহীন প্রমদাকে বিয়ে করবনা’।
‘সাব্বাস হৃদয়হীন কখনো কাঁদেনা’।
‘কুম্ভীরাশ্রু শব্দটা নিশ্চই শুনেছেন’?
আমি হাসতে হাসতে বললাম, ‘আমাকে হাসাতে চাও কেন’?
অনীহ কিংকর্তব্যবিমূঢ় হয়ে আশ্চর্যাম্ভিতকন্ঠে বলল, ‘আমার দুঃখের কাহিনী শুনে আপনি হাসছেন’!
‘থোড়াক্ষণ জিরাবার জন্য আমি একটু বসি’। হাসতে হাসতে বলে গাছে হেলান দিয়ে বসে তার মুখের পানে তাকিয়ে অন্তহাসি হেসে বললাম, ‘বান্দরের কলজে খাবার জন্য কুমির নাকি কান্দে। তাই আমি হাসছিলাম’।
‘আপনি আমাকে কুমিরের সাথে তুলনা করছেন? আমি তাজ্জব হচ্ছি’!
‘আরে ভাই আমার পাশে বস। বিশ্লেষণ করছি’।
‘কুমিররা কখনই কান্দেনা’। মাথা নেড়ে বলে বেজার হয়ে অনীহ বসল।
‘ডাকপুরুষরা কখনই মিথ্যা বলেনা’।
আমার মুখের পানে তাকিয়ে বলল, ‘কি বলতে চাইছেন’!
‘আছাড় পটকান খেয়ে কাছে এসে আস্তেব্যাস্তে সামনে বসে কান্দে আত্মপরায়ণরা কাজ হাসিল করার জন্য। ইষ্টসিদ্ধি হলেই বুড়োআঙ্গুল দেখায়’।
‘আপনি বলছেন, আমি আত্মপরায়ণ’!
‘আউলাঝাউলা হয়ে তুমি আউলিয়া হতে পারবেনা’
‘এই বলেন আত্মপরায়ণ, এই বলেন আউলিয়া। আচকাআচকি করে কি বলতে চাইছেন, বুঝিয়ে বলোন? আমার প্রথমরিপু তেরিমেরি করছে’।
‘তাঁইশ তাড়স ভুলে আমার কথা শুন, সরসী তোমাকে ভালবাসে। ওর কাছে ফিরে যাও। দুজন সুখি হবে’।
‘মা বাবা আমার জন্য পাত্রী খোঁজছেন। অদ্য বিয়ে করব’।
‘কি বলতে চাইছ’!
‘পিটিয়ে ধুম্বা বানালেও সরসীকে আমি বিয়ে করবনা’। দৃঢ়কন্ঠে বলল।
‘কেন’!
‘নিরালায় বসলেই আমি মনের কানে থাপ্পড়ের প্রতিধ্বনি শুনি, তাই’।
‘ঝিলের পাড়ে বসে তুমি সরসীকে ভুলতে পারবেনা’।
‘জানি সরসীরা মজাপুকুর। তাই নদীকে বিয়ে করে আমি আনন্দস্রোতে ভাসব’।
‘দোয়া করি তুমি চিরসুখি হও’। বলে হাঁটুতে ভর দিয়ে আমি দাঁড়ালাম।
‘ওস্তাদ, আমাকে থোড়া সাহাস্য করবেন’? ব্যস্তসুরে বলে লাফ দিয়ে দাঁড়িয়ে আমার সামনে এসে চাটুকার মত হাত মলে কপটহাসি হেসে বলল, ‘হে বদান্য, কারুণ্য চাই আমি জানি সদন্তঃকরণবিশিষ্ট আপনি সদয় হয়ে আমাকে থোড়া সাহায্য করলে, আমার চোদ্দপুরুষ উদ্ধার হবে’।
‘ভুজুং দিয়ে গুলতাপ্পি করার সময় আমার নেই’।
‘এই জন্যই ম্যাঁও ধরে আপনি দাও মারতে পারছেনা’। বলে নাক সিঁটকাল।
‘অনীহ, চোঙায় ফুঁকে বাতাস দিয়ে গোসাঘরে আগুন জ্বালালে তুমি ফাঁড়ায় পড়বে। তাই বলছি, যা বলার সহজ ভাষায় বুঝিয়ে বল। সরসীকে কাঁদতে দেখে আমার মন রেগে ব্যোম হয়ে আছে। তাই আমি টং করে ফাটাতে চাইনা’।
‘থোড়া মস্করা করলে মন হাল্কা হয়। কিন্তু আপনার সাথে রসিকথাও করা যায়না। অতো নিরস হয়েছেন কেন’?
‘আমার দুঃখের কাহিনী শুনে তুমি মহানায়ক হতে পারবেনা। তাই বল, তারপরি কি করবে’?
‘গুলতাপ্পি করে আড়াইঘরে চাপা দিয়ে সরসীকে গোলোকধামে হারাতে হবে। নতুবা দোফাঁদে বাঘবন্দী হবে সাড়েসর্বনাশ’।
‘ধাপ্পাবাজ তুমি পট্টিবাজি করতে চাও নাকি’!
‘নিরুপায় আমি এখন সুখি হতে চাই মাত্র’।
‘কি করতে চাও’?
‘ধান্দাবাজি করে আমি সরসীর চোখে ভেলকি লাগাতে চাই’।
‘কালবেলায় ভানোমতীর খেলা দেখলে আমার চক্ষু চড়ক গাছ হয় মন মগজ হতভম্ভ। তাই বলছিলাম কি, বলতে আরম্ভ কর’।
‘আজ না আরেক দিন’। বলে অনীহ হাঁটতে লাগল।
‘অনীহ, তুমি জান এমন ব্যবহারে আমি রাগান্বিত হই। জেনেও এমন করলে কেন’!
‘গায়েরজোরে ঠাস করে আমার গালে থাবড়া মেরেছিল কেন’?
‘আমি অতিদুঃখিত। ক্ষমা কর। আমার ভুল হয়েছে’।
অনীহ দাঁড়িয়ে ঘাড় বাঁকিয়ে বিদ্রুপহাসি হেসে বলল, ‘বার বার তিনবার ক্ষমা চাইলেন কেন’?
‘থাক ও সব। এখন বল তারপর কি করবে’? বলে আমি ধীরে ধীরে তার পানে এগুলাম।
‘কলিটা আজই নজরগোচর হয়েছিল। চিন্তকের মত চিন্তাভাবনা করে পাঠিয়েছিলাম। কাঁদবে জানলে পাঠাতামনা’।
‘ভালই করেছ। নিরিবিলি একলা বসলে তোমার কথা স্মরণ করবে। বার বার এক পলকে তিনবার’।
‘হৃদয়হীন কে, আমি না আপনি’? অনীহ বিশারদের মত হেসে বলল।
‘ছায়াবিতানে যেয়ে প্রেমাসনে একলা বসলে, প্রিয়জনের কথা স্মরণ হয়। মন তন্ময় হয়ে স্মৃতিচারণ করে। সেই লগনে কন্ঠলগ্ন না হয়ে থাপ্পড়ের ধ্বনি মনের-কানে প্রতিধ্বনিত হলে, মগজ খিঁচড়ে মন বিগড়ে যায়। যাক, এখন কি করবে’?
‘বাঁধনহারা বাউন্ডেলের মত ঘোরে বেড়াব’। বলে আমার চোখের পানে তাকিয়ে বলল, ‘চাইলে সাথী হতে পারবেন’।
‘আমার অনেক কাজ কাছে। তাই আমি খামকাজ করিনা’।
‘খামোখা আচকাআচকি করছেন কেন’? বলে বিরক্তউক্তি করল।
‘দমসম টেনে আইঢাই করে আচকা বললে আচম্বিত শব্দটা শুনে মনে খুঁতখুঁতানি হয় সত্যি। কিন্তু আচম্বিতে আপনজন সামনে এলে প্রাণান্তকর অন্তর্বেদনা ভুলে মন আনন্দে নেচে প্রাণবন্ত হয়’।
‘কি বলতে চাইছেন দয়াকরে বুঝিয়ে বলোন’।
আমার নিরানন্দ মন কেঁদে বলে, নন্দ চাই আমাতে প্রাণবন্ততা নেই,
মনোরঞ্জন করব প্রিয়া হে তোমার নামে আজো আমি পুষ্পাঞ্জলি দেই।
‘থামলেন কেন’! অনীহ অধীর হয়ে বলল।
‘গাইন নয় আমি গান গাইতে পারিনা। যাক, আমি এখন চলে যাব। চক্রবাঁকে আবার দেখা হবে’।
‘কথায় বলেনা, পিটিয়ে ঘোড়া বানানো যায়না গাধা আজন্মের গতরখেকো গেঁতো’।
‘ঘোঁতঘাত জানলে তুমি ঘোঁত করে উঠবে, আঁতিপাতি জানার জন্য। তাই সূত্র বলবনা’। বলে শিস দিয়ে তালে বেতালে গাইতে শুরু করে সামনে তাকিয়ে দেখি, ধলা ময়নার মত দুহাতে মেল সরসী বাতাসে উড়াল দিতে চাইছে। তারপর কি করে দেখার জন্য হিজলগাছে হেলান দিয়ে বার বার কয়েকবার পলক মেরে কুকপাখির মত অপলকদৃষ্টিতে তাকিয়ে দেখি, প্রজাপতির মত ডান ঝাপটে ফুলপরীর মত নেচে বিরহের গান গাইছে,
রসিক বন্ধুরে তনুপরশ চাই তনে তাপন উঠেছে,
আস বন্ধু হাত ধরে যাব মোরা কুঞ্জকাননে।
বসন্তসখা এসেছে মধুপায়ি মধুবনে,
কন্ঠলগ্নে অধরমধু পান করব বসে প্রেমাসনে।
বন্ধুয়ারে, অমাবস্যায় চাঁদনি হাসে আশমানে,
মেঘের আঁচলে তারারা লুকায় আমার মনের কথা শুনে।
কামেচ্ছা মনে শত আশা মধুর পিরিতি করব দুজনে,
বন্ধুয়ারে, মুচকি হেসে আস আমার নিধুবনে।
গান গেয়ে স্মিতহাসি হেসে গোলাপে ধরে চুমু দিতে চেয়ে সাথে সাথে ছেড়ে বিষাদগ্রস্থ হয়ে হাত ঝাড়তে লাগল। অনুপলে বিষাক্ত গোলাপের বিষ সর্বাঙ্গে ছড়িয়ে পড়েছে। বিষে জর্জরিত হয়ে ডানে বাঁয়ে তাকিয়ে বনফুলে সাজানো প্রেমাসনের পানে পা বাড়িয়ে এলিয়ে পড়ল। কষ্ট করে উঠতে চেয়ে অপারগ হয়ে প্রেমাসনের পানে ডান হাত প্রসারিত করে বাজুতে মুখ লুকিয়ে ডুকরে কেঁদে উঠল। সরসীকে কাঁদতে দেখে আমি দৌড়ে এসে সামনে বসে দু হাত প্রসারিত করলাম। আমার চোখের পানে তাকিয়ে ম্লান বিচলিত হাসি হেসে ডান হাত প্রসারিত করে বেদনাভারাতুর কন্ঠে বলল, ‘হাত ধরে উঠিয়ে আমাকে প্রেমাসনে বসাবে’?
‘নিশ্চই’। ব্যস্তসুরে বলে গোলাপের মত আলগোছে ধরে প্রেমাসনে বসিয়ে বিমনীভূত হয়ে বললাম, ‘অনুমতি পেলে আমি তোমাকে বাহুতে তোলে হাসপাতালে নিয়ে যাব’।
‘স্বেচ্ছায় পটোলতোলায় এসেছি আমি ছায়াবিতানে অন্তিমশয়ন করতে চাই’।
‘জান…। বলে বাহুতে তোলে হাঁটতে হাঁটতে চোখের পানে তাকিয়ে বললাম, ‘ঢাকের বাঁয়া অকাল-কুষ্মান্ডটা কাঁঠালের আমসত্ত্ব খেতে চায় গাছে না উঠতেই এক কাঁদি। তাই গেঁতোর থোঁতামুখ ভোঁতা হয়েছে’।
‘অতি ঘরন্তী না পায় ঘর, প্রবাদটা জানতামনা আমি বকান্ডপ্রত্যাশায় অনীহকে ভালবেসেছিলাম’। বলে স্বস্তিতে পলক মেরে নয়ন কোণে জমা নোনাজল ঝরিয়ে, ধীরে ধীরে চোখ মেলে মৃদু হেসে বলল, ‘জান, সোনার হরিণের নাম স্বর্ণমৃগ এবং মরীচিকায় জল নেই আলেয়ার মাঝে আলো। তাই তোমার বাহুতে আমি পাথর সম স্বপ্নহীন নয়ন পানে তাকিয়ে আছি’।
‘জল জমে স্বপ্নহীন নয়ন স্বপ্নীল হয়েছে মন জিজীবিষু। অকাল-বসন্তে মরতে চাইনা আমি মনের সুখে বাঁচতে চিকীষর্ু’।
‘যা প্রাণে চায় তা পেয়ে তুমি মনের সাধমিটিয়ে আমাকে ভালবাসলে সিদ্ধমনোরথে আমি তোমাকে ভালবাসব। আশা মিটিয়ে কামকলা করলে নিধুবনে আমি তোমাকে যৌবনমদ পান করাব’।
‘তোমাদেরে হয়েছেটা কি’? আমি বিরক্ত হয়ে বললাম।
‘বললে জবাব বলব’। বলে দু হাতে আমার গলা জড়িয়ে ধরে চক্ষুদ্বয় বোঁজে নিস্পন্দীভূত হল।
উৎকন্ঠতায় উদগীব হয়ে, ‘সরসী, এই সরসী’। বার বার কয়েকবার ডেকে সাড়া না পেয়ে কপাল দিয়ে কপালে ঢুঁস মারলাম। নড়াছড়া করছেনা দেখে দৌড়ে রাস্তার পাশে এসে ক্যাব থামিয়ে অরোগ্যনিকেতনে নিয়ে এলাম। থিয়েটারে নিয়ে ও-টি অবেদন স্পর্শহানি করেও ডাক্তার নার্সরা কোণঠাসা খেয়ে দু হাত উঠিয়ে বলল, ‘হায় হায়, যায়-যায় এখন-তখন নাভিশ্বাস উঠবে রোগীর হয়ে এসেছে। দৈবচিকিৎসায় ব্যর্থ হয়ে স্বপ্নাদ্য চিকিৎসা করালে সফলকাম হবেন। নতুবা ঘাটের-মড়াকে নিয়ে যমে মানুষে টানাটানি আরম্ভ হবে’।
তাদের উপদেশ মত বৈদ্যশাস্ত্র পড়ে, সদৃশবিধান অনুযায়ি তুকতাক করে জলপড়া দিয়ে গোসল করিয়ে, তেলপড়া মাথায় মাখিয়ে, টোটকা তাবিজ গলায় কোমরে বেঁধেও রোগমোচন করতে পারিনি। ব্যর্থমনোরথে স্বর্গোদ্যানে নিয়ে এসে, পুষ্পশয্যা পেতে প্রেমাসনে শয়ন করিয়ে অপলকদৃষ্টিতে তাকিয়ে তন্ময় হয়ে আমি ওর ভূবমোহন বিধূবদন দেখছি। হু হু করে হাড় কাঁপিয়ে উত্তুরি বাতাস এলোপাথাড়ে বইছে। দাঁড়িয়ে চোখ বোঁজে বুক ভরে দীর্ঘশ্বাস টেনে থরহরি করে বাজুতে দু হাত ঘেঁষে হাঁফ ছাড়লে, মাঘের ঠান্ডায় অনুপলের জন্য অন্তর্জ্বালা নিভে বুকের ভিতর থেকে খানিক দুঃখ বেড়িয়ে এল ধোঁয়া হয়ে। তারপর কি করব নিয়ে আমি চিন্তি হলে মনের কানে শুনতে পেলাম,
ইচ্ছা মনে আশা ছিল, প্রেমে মজে প্রেমীক হব রঙ্গিলা,
সজনীগো, সর্বহারা আমি অখন অপ্রেমিক হয়েছি একেলা।
নয়ন জলে বুক ভিজে দিবাতন আমার মনে জ্বালা,
মনের আশা মনে রইল নয়ন কোণে জলের খেলা।
গলার মালা হতে চেয়ে আমি গলায় পরলাম ফকিরা-মালা,
সজনীগো গরলে মন ভরা তোমার মনটা পাথর, তুমি অবলা।
ভালবেসে আশা ছিল তোমার সাথে করব রংলীলা,
সজনীগো মিলনাশা আমার জন্য কাল হয়েছে প্রেমলীলা।
গান থামলে আমি চিৎকার করে বললাম, ‘অনীহ, এমন করলে কেন’?
‘নিধুবনে তনুমিলন করতে পারিনি আমি ওকে খুন করেছি মধুবনে’। কে যেন হাঁক দিয়ে বলল।
‘আমার সামনে আয়’! আমি গর্জে উঠলাম।
‘গলা ফাটিয়ে লাভ হবেনা’। ক্ষিণ আওয়াজ ভেসে এল।
‘অনীহ ফিরে আয়। সরসীকে আমি বাঁচাতে পারবনা’। আমি বিচলিত হয়ে বললাম।
‘বুকের খাচায় চটপট করে মনপাখি উড়ে গেলে জীবনলীলা সাঙ্গ হয়। আজ আমি জানলাম’।
আমি কিছু বলব এমনসময় মেয়েলি কন্ঠসুর বাতাসে ভেসে এল,
বুকের খাচায় বসে মনমুনিয়া সুখের গান গায়,
সুখবসন্তে মনের বনে মনভোমরা গুনগুনায়,
বন্ধুয়ারে, তোমার বিরহে জ্বলছে অনল আমার অন্তরায়।
আমি দৌড়ে সরসীর পাশে এসে পরখ করে তাকিয়ে, নড়ছেনা দেখে কপালে হাত বুলিয়ে, মাথা নেড়ে একটা দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে দাঁড়িয়ে মাথা তুলে, চাঁদকে মেঘের আড়ালে লুকাতে দেখে অন্তম্লান হসে, ‘অবুঝ তোমরা বুঝতে চাওনা কেন’? বলে মাথা নত করলে চাঁদের আলো থেকে অপ্সরা আবির্ভূত হয়ে রোষ্টসুরে বলল, ‘কি বুঝব’?
আমি চমকে উঠে মাথা তুলে তাকিয়ে অপ্সরাকে দেখে কম্পিতসুরে জানতে চাইলাম, ‘কে আপনি কোত্থে এলেন’!
‘অবুঝ আমরা কি বুঝতে চাইনা, বুঝিয়ে বল’? অপ্সরা চোখ পাকিয়ে বলল।
‘আমি আমার মনে সাথে কথা বলছিলাম মাত্র। শুনে আপনি আচকাআচকি করছেন কেন’?
‘আমিই তোমার মানসী’। অপ্সরা দাঁত খিঁচিয়ে বলল।
‘আমি অতি দুঃখিত’। বলে মুখ ফিরালে আলোবেগে অপ্সরা আমার সামনে এসে রাগান্বিত সুরে বলল, ‘জবাব দিচ্ছনা কেন’?
‘আমি জানতে চেয়েছিলাম’। বলে অপলকদৃষ্টিতে চোখের পানে তাকালম।
‘এমন করে তাকাচ্ছ কেন’!
নয়ন জলে বুক ভিজে দিবাতন আমার মনে জ্বালা,
মনের আশা মনে রইল নয়ন কোণে জলের খেলা।
অপ্সরা কপাল কুঁচ করে বলল, ‘তুমি গাইলে কেন’?
‘আমার গান আমি গাইছি। শুনে তোমার কপাল কুঁচ হচ্ছে কেন’?
‘সরসীকে বাঁচাবে কেমন করে’? বলে অপ্সরা সরীর পানে তাকাল।
‘আয়ূ বাকি থাকলে বাঁচবে ইনশাল্লাহ’।
‘তুমি অত পাষাণ কেন’! দু হাত মুষ্টিবদ্ধ করে অপ্সরা গায়ের জোরে বলল।
‘আমার কানের পোকা বার করলেও জবাব মিলবেনা। অনেকে জানে, আমি যে আজন্মের পাষাণ’। বলে আমি কাঁধ বাঁকালাম।
‘প্রতারক কে, আমি না তুমি’?
‘আমি কি জানি’। ঠোঁট উল্টিয়ে বলল।
‘ঢঙ্গী তুমি জবর বড় ডিঙ্গর’। বলে অপ্সরা নাক সিঁটকাল।
‘ধিঙ্গিবুড়ি তুমিওতো রঙ্গিণী হয়েছ’। বিদ্রুপহাসি হেসে বললাম।
‘খামোখা আমার মগজ খিচড়াতে চাইছ কেন? কু ডাক শুনে আলাই ডেকে তুমি ফাড়ায় পড়তে চাও নাকি’?
‘এখন বেশি আচকাআচকি করছ। মাথা গরম হলে অনুপলে লীন হবে’।
‘চেতাবনি দিয়ে আমাকে ভয়ত্রস্ত করতে চাইছ নাকি’?
‘সাবধান করছি মাত্র’। কাঁধ বাঁকিয়ে বলে আমি লতাবিতান থেকে বেরিয়ে হাঁটতে লাগলাম।
‘ঘুমন্ত-সুন্দীরর কি করবে’?
‘সুপ্তবিতনু আমার মাথা ব্যথার কারণ নয়’।
‘অত পঁ্যাচোয়া কেন’?
‘পরবর্তি বইর নাম সুপ্তবিতনু। তাই বললাম অনুগ্রহপূর্বক রাগ করনা’।
‘পরিকথার রাজ কুমার কবে আসবে’?
‘পক্ষীরাজে ছড়ে আস্তেব্যাস্তে আসেবে, ধীরে ধীরে উড়ে’।
‘কি শুরু করেছো’?
‘মায়, আমার সাথে আচকাআচকি করছ কেন, আমি কি করলাম’?
‘সরসী মরলে, বেজুত করে তোমাকে সাবুদ করব’। বলে অপ্সরা দাঁতে দাঁত পিঁষল।
‘আমাকে পিঠিয়ে লম্বা করলেও পিঠা খেতে পারবেনা’। বলে হাত উঠিয়ে নাড়তে নাড়তে হাঁঠতে লাগলাম।
‘বিবাগী, দাঁড়াও’! হাঁক দিয়ে দম্ভোলির মত সামনে আবির্ভূত হল।
‘বাজ ডেকে মেঘজ্যোতির মত আবির্ভূত হলে কেন, জ্বালিয়ে ছারখার করতে চাও নাকি’? বলে ঠোঁট বাঁকিয়ে বিদ্রুপ হাসি হাসলাম।
অশ্রু টলমল নয়নে তাকিয়ে বিচলিত হয়ে বলল, ‘বিবাগী, অষ্টপ্রহর কাঁদিয়ে কালিনী বানিয়েছ আমাকে কেন বানাতে চাও অভাগী’?
‘মায়, আমি কি করলাম! এবং সুখ কেড়ে দুখ দেবার সাধ্য আমার নেই। তবে এমন আচম্বিত কথা বলছ কেন’?
‘আজো ভালবাসি তোমাকে আমি জন্মাবিচ্ছিন্ন ভালবাসব’।
‘সবপেয়েছির দেশে দেখা হলে, কল্পবৃক্ষে হেলান দিয়ে বসে এক গাল হেসে তোমার সাথে থোড়াক্ষণ গপসপ করব। এখন খামকাজ কর যেয়ে’।
‘এমন কর কেন’? অপ্সরা হতাশ হয়ে কাঁদ ঝুলিয়ে বলল।
‘তাড়া তাঁইশ নৈরাশার চাবি। তাই আমি আর হতাশ হতে চাইনা’।
‘আগে যদি জানতামরে বন্ধু পাষাণ তুমি অত নিঠুর তোমার লগে খেলতামনা প্রেমের লাই। আগেবাগে বাগে বশ করে আমারে তন্ত্রমন্ত্র জপে মনের কথা অন্তরের করছ ফাঁই। সুখশান্তি অন্তরে নাইরে নিঠুর বন্ধু মান ভুল উরে ঠান প্রেমের দোই’।
অসমাপ্ত
লেখাটা কেমন দয়াকরে আমাকে জানাবেন ধন্যবাদ
কবিআব্দুল