একুশে বইমেলার কাব্যগ্রন্থ “দহন কালের কাব্য ”
–এম,এ মান্নান (রিপন)
কবি শফিকুল ইসলামের চিন্তা চেতনা বা দর্শন অনেকটাই এদেশের সাধারণ মানুষদের নিয়ে। যাদের অধিকাংশই মেহনতী শ্রমজীবী। যাদেরকে খেটে খাওয়া, সর্বহারা, সামাজিক বঞ্চিত মানব শ্রেণীকে বুঝায়। তার প্রকাশিত অন্যান্য কাব্যগ্রন্থে এ সম্পর্কে ধারনা আমরা পেয়েছি। কিন্তু আমি অনেকটা বিস্মিত হয়েছি তার একটি কাব্যগ্রন্থটি পড়ে। বইটি পড়তে গিয়ে আমি বার বার আর্শ্চাযিত হয়েছি বইটির প্রতিটি কবিতা পড়ে। মনে হল এত লুপ্ত নয় অনেকটাই সুপ্ত– জীবন্ত সময়ের ব্যপ্তিহীন জীবন্ত। উৎসর্গ টিকায় ছুঁড়ে দেওয়া হয়েছে কবি রবি ঠাকুরের সেই চিরচেনা অনুপ্রাণিত উৎসাহ উদ্দীপনার বানীঃ–
‘উদয়ের পথে শুনি কার বাণী
ভয় নাই ওরে ভয় নাই-
নিঃশেষে প্রাণ যে করিবে দান
ক্ষয় নাই তার ক্ষয় নাই’…
মনে হয় কবি কোন এক লক্ষ্যে আমাদেরকে নিয়ে যাওয়ার আহবান করছেন। প্রথমেই যে কবিতাটি চোখে পড়ে তা হল ‘সম্মুখে বাধা আছে’ শিরোনামে। তাতে রয়েছে সর্ব সমাজে সর্ব সময়ের আকাঙ্খিত মানবতার মুক্তির বাণী। কবি লিখেনঃ-
“সম্মুখে বাধা আছে, পথ বন্ধুর
তবু জানি যেতে হবে বহুদূর।
পায়ে ফুটুক যতই কাটা
থামলে চলবে না এ পথ হাটা
সীমিত সময়, তবু পথ অনেক দূর”
(সম্মুখে বাধা আছে)
একটি সঠিক লক্ষে পৌছার কথা কবি তার কবিতায় আহবান করছেন। কিন্তু কবি একথাও উল্লেখ করেছেন এ পথ অনেক দীর্ঘ ও কন্টযুক্ত যেখানে পৌছুতে হলে অনেক বাধা সমস্যা দেখা দিতে পারে। নিন্দা-ধিকৃতি এ পথে চির বাধা। তা সত্ত্বেও লক্ষ্যে পৌছুতে বিপ্লবীকে করতে হবে শক্রর মোকাবেলা। কবি লিখেনঃ–
“চলতে পথে শত কুমন্ত্রণা
হাসিমুখে সয়ে যত যন্ত্রণা
করতে হবে মোকাবিলা শক্রর।
সত্যের পথ কুসুমিত নয়
জেনেই বিপ্লবীর চলতে হয়
বিপ্লবী মন পরোয়া করে না মৃত্যুর”
(সম্মুখে বাধা আছে)
পরবর্তী কবিতায় কবি আহবান করেন সেই একই বাণী। যেখানে চিত্রিত হয়েছে সাম্য সমতার এক সুন্দর আগামী। কবি লিখেনঃ–
“পথ যতো হোক বন্ধুর, বন্ধু যেওনা থামি
আসবেই আসবে সুন্দর আগামী”
(পথ যতো হোক বন্ধুর, বন্ধু যেওনা থামি)
এ দুটি কবিতার বক্তব্য আমার কাছে অনেকটা পরিচিত মনে হল। আর পরিচিত মনে হবেই না কেন এ কথাতো অধিকাংশ মুক্তিকামী স্বাধীনচিত্ত মানুষের কথা। বর্তমান সময়ে সাম্রাজ্যবাদী-পুঁজিবাদী আগ্রাসনের ফলে যদিও সাধারন মানুষকে আষ্টেপৃষ্টে বেধে রেখে তাদের মুখের ভাষা অনেকটা কেড়ে নিয়েছে। ভূলুন্ঠিত করেছে স্বাধীনতার স্বপ্ন, সেখানে সে কথাগুলো মানুষের কাছে অব্যক্তই থেকেই যায়। কিন্তু কবিকে তা পীড়া দেয় যুগ যুগ ধরে। তাই ত্রিশের দশকে বাংলা সাহিত্যে কবিদের লিখনীতে আমরা তা লক্ষ্য করি। যা অনেকটা গণ সংগীতের ধাচে রচিত হয়েছিল। উপরোক্ত কবিতা দু’টিতে এমনি বৈশিষ্ট্য লক্ষ্য করা গেছে। এতে সুর দিলে স্বার্থক গণ সংগীতই হবে। প্রাণ ফিরে পাবে কবিতার কথাগুলো মানুষের হৃদয়, মন ও মননে, গানে গানে। কারণ এতে রয়েছে শ্রেণী সংগ্রাম,বিপ্লব,জনগণের অভাব অনটন, মজুতদার, লুটেরা বা বুর্জোয়াদের বিরুদ্ধে বিপ্লবীদের লড়াইয়ের কথা।
বাংলাদেশে গণসংগীতের প্রবক্তা কবি কাজী নজরুল ইসলাম, তাঁর “কারার ঐ লৌহ কপাট, ভেঙ্গে ফেল কররে লোপাট”… এর মাধ্যমে। নজরুল পরবর্তী সময়ে এ ধরনের বক্তব্য খুব কমই শুনা গেছে। আর গেলেও তা অনেকটা ছিল আপোষ ভূমিকায়। কিন্তু কবি শফিকুল ইসলাম তাঁর কবিতায় যে আপোষহীন বিপ্লবী মন্ত্রনা দিয়েছেন তা সত্যিই সাহসী ভূমিকা রাখে। কিন্তু কবির স্বার্থকতা এখানে বক্তব্যে নয় কারণ এ ধরনের বক্তব্য আমরা ইতিপূর্বে অনেক লক্ষ্য করেছি। মূলত এখানে তার স্বার্থকতা নিহিত রয়েছে তাঁর প্রদত্ত মেসেজে এ। কবিতাগুলো বিশ্লেষন করলে এই বিষয়টি পরিলতি হবে। পাশাপাশি তাঁর কবিতায় রয়েছে নির্দিষ্ট লক্ষ্য- দিক নির্দেশনা এবং লক্ষে্য পৌছার মূলে অনেক উৎসাহ ও প্রেরণা। যেমন,কবি লিখেনঃ–
“আমাদের সঙ্গী জাগ্রত জনতা
আমরা তো নই একা
আধারের বুক চিড়ে আমরা
জাগাব আলোর রেখা।
আমাদের আছে প্রত্যয়
জয় হবেই আমাদের জয়-
শুধু বিশ্বাসকে সম্বল করে
আজ চলছি পথ আধার-ঢাকা”
(আমাদের সঙ্গী জাগ্রত জনতা)
গণ সংগীত ধারায় রচিত কবিতা বাংলা সাহিত্যে একটি গুরুত্বপূর্ণ অধ্যায়। দীর্ঘ বৃটিশ ঔপনিবেশিক শাসন-শোষন,পাকিস্তানীদের শোষন ও বঞ্চনা স্বাধীনতা পরবর্তী দীর্ঘ সময়ে স্বৈরাচারী শাসন সময়কালে এ ধারার কবিতাগুলো রচিত হয়। ত্রিশ এর দশকে প্রেমেন্দ্র মিত্র লিখেনঃ–
“আমি কবি যত কামারের আর কুমোরের
কাসারের আর ছুতোরের
মুটে মজুরের
আমি কবি যত ইতরের।”
জীবনানন্দ দাশের ভাষায়ঃ–
“যাদের গভীর আস্থা আছে
আজো মানুষের প্রতি
এখনো যাদের কাছে স্বাভাবিক
বলে মনে হয়
মহৎ সত্য বা রীতি, কিংবা শিল্প বা সাধনা
শকুন ও শেয়ালের খাদ্য আজ তাদের হৃদয়।”
সেই সময়েই কবি সুকান্ত গর্জে উঠলেনঃ–
“বিদ্রোহ আজ, বিদ্রোহ চারিদিকে
আমি যাই তার দিন পঞ্জিকা লিখে।”
স্বাধীনতা পরবর্তী সময়ে আশির দশকেও শুনা গেছেঃ–
“চল চলরে কমরেড চল
মুক্তি নেশায় মন উতল…।
সর্ব হারার দল, দুঃখ কিসের বল
হাতে কাস্তে হাতুড়ি,‘কারে ভয় করি
রক্ত সাগর বুকে মোদের মুক্তি শতদল।”
কিন্তু স্বাধীনতাত্তোর সময় থেকে দীর্ঘ ছত্রিশ বৎসর যাবত শোষন-বঞ্চনা, অসম সামাজিক কাঠামো, সর্বত্র শ্রেণী বৈষম্যের বিভীষিকাময় রূপ, প্রতিনিয়ত মৌলিক অধিকার খর্ব, মানবাধিকার হরণ, লুন্টন এদেশের সাধারণ শ্রমজীবি কৃষক, গার্মেন্টস শ্রমিক, রাজমিস্ত্রী, পথের ধারে গগনচুম্বী প্রাসাদ তৈরীর জন্য ইট-পাথর ভাঙ্গা তরুন তরুনী, ডাক পিয়ন, নৈশ প্রহরী, দলিত শ্রেণী, টোকাই, বস্তিবাসী অসহায় নিঃস্ব সর্বহারা মানুষেরদের নিয়ে কবিতা তেমন রচিত হয়নি। কবি শফিকুল ইসলাম এ ক্ষেত্রে বাংলা সাহিত্যে একটি নতুন সংযোজন বলা যায়। “দহন কালের কাব্য”তে তিনি এই সকল মানুষের মুক্তির চির সত্য পথ দেখিয়েছেনঃ–
“আমার দেশের শ্রমিকের বলিষ্ঠ বাহু
আমার সংগ্রামী উদ্দীপনা-
কৃষকের ঘামে-ভেজা মুখ বাচার প্রেরণা।
যে শ্রমিক কাজ করে কলেকারখানায়
যে কৃষক মাঠে ফসল ফলায়
সভ্যতার পথ যারা গড়ে দিল
তারাই আমার স্বজন,আমার চিরচেনা”
(“আমার দেশের শ্রমিকের বলিষ্ঠ বাহু”)
কবির এই অসাধারণ সৃষ্টিকর্ম বর্তমান বাংলা সাহিত্যে প্রগতি ও উদারতার ধারায় বহুমাত্রিকতা দান করেছে। নজরুল যেখানে আজীবন বিপ্লবী হতে পারেনি (বিদ্রোহী যার অন্যতম বৈশিষ্ট্য ছিল), রবীন্দ্র যেখানে সংস্কারের বাণীতে ডুবে ছিল কবি শফিকুল ইসলাম সেখানে অনেকটা সুকান্তের ন্যায় বিপ্লবী মূর্তি ধারণ করেছেন।নৈরাজ্যবাদ, সাম্রাজ্যবাদ,পুঁজিবাদের সাথে সমাজতন্ত্রের মুক্ত চিন্তার লড়াইয়ে শান্তি স্বাধীনতা কামনা করেছেন। যেখানে প্রধান শক্তি হিসাবে সাধারণ জনগনের কথা উল্লেখ করেছেন।
নজরুল রবীন্দ্রসহ অন্যান্য (সুকান্ত ব্যতীত) যে সকল কবি সামাজিক শোষন, নির্যাতনের উপর কবিতা লিখেছেন তাদের সাথে কবি শফিকুল ইসলামের পার্থক্য হল প্রথমতঃ তারা কেউই যথাযথভাবে শ্রেণী সচেতন ছিল না। কেউই শোষিত জনতার সাথে সর্বাত্বকভাবে একাত্বতা বোধ করেননি। তাদের সামগ্রিক সৃষ্টি কর্মের মধ্যে এত ক্ষুদ্র অংশের ন্যায় ছিল। কবি শফিকুল ইসলাম এ ক্ষেত্রে সকল রাজনৈতিক মতবাদের উর্ধ্বে মানবিক মতবাদের বাণী প্রচার করেছেন। সময়ের সকল দাবীর বলয়ে তার এই দর্শন চিন্তা অনেকটাই অগ্নিস্ফুরণ।
তাই সব শেষে বলা যায় কবি শফিকুল ইসলাম স্বার্থক তাঁর এই রচনায়। তাঁর চিন্তায় বেচে থাকবে যুগ যুগ ধরে যতদিন মানুষ রবে এই ধরাতলে। কারণ তিনি মূলত এদেশের সর্বহারা শ্রমজীবি মানুষের জয় গান নিয়েই লিখেছেন। সেখানে খুজেছেন তাঁর আসল ঠিকানা। কবি লিখেনঃ–
“মাটির পৃথিবীকে যারা দিল প্রাণ
অথচ যারা পেলনা সম্মান-
সেই শ্রমজীবি মানুষের
সমাবেশই আমার স্থায়ী ঠিকানা।”
(“আমার দেশের শ্রমিকের বলিষ্ঠ বাহু”)
[গ্রন্থের নাম-“দহন কালের কাব্য”লেখক- শফিকুল ইসলাম। প্রচ্ছদ-আসলাম। প্রকাশক- মিজান পাবলিশার্স ৩৮/৪বাংলাবাজার,ঢাকা-১১০০। ফোন-৯৫১২৯৪৬,৭১১১৪৩৬। মোবাইল- ০১৫৫২৩৯১৩৪১।