১.
আবার বন্যা। আগের বার ঘরের মধ্যে হাঁটুজল হলেও এবার শুধু উঠানের কিনারাগুলো ছুঁয়েছে। ভিটে আর পুকুরের পাড়ও এবার জেগে আছে। ডুবেছে আমার প্রাইমারী স্কুলের মাঠ। তবুও ক্লাস চলছে, ঢিলেঢালা ভাবে। এই অসময়েও স্কুলে যোগ হলো একটি নতুন মুখ।
কর্মসূত্রে আমাদের এলাকায় এসে পড়ল একটি নতুন ফ্যামিলি। বন্যার মধ্যেই পাড়ার ঘাটে এসে ভিড়ল বিশাল এক নৌকা। তাতে পুরো একটা ঘর বসানো। আমাদের পাড়ার একজন জায়গা দিলে সেখানে সেই ঘর একদিনের মধ্যে সেট করা হয়ে গেল। আমরা তো অবাক।
অবাক হবার পালা আরো বেড়ে গেল- দুদিন পর মা-বাবার হাত ধরে নৌকা থেকে নামল একটা পরী। চেহারা আর গায়ের রঙ দেখেই সবাই বলাবলি করছে এমন মেয়ে আমাদের গ্রামে একটাও নাই। আমাদের গ্রামের প্রাইমারীতেই আমার দুই ক্লাস নিচে ভর্তি হল। গম্ভীর, কথা কম বলে। কিন্তু কোনো কিছুই তার বড় বড় চোখদুটিকে ফাঁকি দিতে পারে না। ওর মাকে যখন ওকে “বুড়ি” বলে ডাকতে শুনলাম তখন বুঝতে পারলাম নামের রহস্য! তবে পোষাকী নামটা রহস্যই থেকে গেল। আমরা আবার এক কাঠি উপরে গিয়ে ক্ষেপাই “পাকা বুড়ি” বলে।
২.
বন্যা বাড়াতে অনির্দষ্টকালের জন্য স্কুল বন্ধ হয়ে গেল। ভোরবেলা ঘুম থেকে উঠেই নৌকায় করে শাপলা তুলে আনি। তারপর উঠানে দাঁড়িয়ে বড়শি দিয়ে পুঁটিমাছ ধরি। বিকেলে সবাই মিলে লুকোচুরি খেলি।
সকালে খাওয়া হয়ে গেলে কাউকে আর পাওয়া যায় না। সবাই কাজে ব্যস্ত হয়ে পড়ে। সারা বাড়িতে পাট আর পাটখড়ি নাড়া। রোদে শুকানো হচ্ছে। বেছে বেছে সবচেয়ে মোটা আর বড় একটা পাটখড়ি নিয়ে তাতে নারিকেল পাতার ছলাকার দুইপ্রান্ত গুঁজে দিয়ে মাকড়সার ফাঁদ জড়িয়ে নেই। তারপর শুরু হয় ফড়িং ধরার পালা। অন্যান্য সব কাজে অনেককে পেলেও এই সময়টা বুড়ি ছাড়া আর কেউ থাকে না সাথে। আমি ফাঁদ দিয়ে ফড়িং ধরে ওর কাছে জমা রাখি। অনেকগুলো হলে ফড়িংগুলোর পাখনা অর্ধেক কেটে দেই। তখন ছেড়ে দিলেও আর উড়তে পারে না।
৩.
দুপুর বেলা। বরাবরের মত ফড়িং শিকার চলছে। অনেকগুলো ধরা পড়েছে। বুড়ির হাত ভরে গেছে। ভাবলাম কিছুর পাখনা কেটে দেই। কাছে গিয়ে বলতেই সবগুলোকে উড়িয়ে দিল। দিলাম প্রচণ্ড এক চড়। ফর্সা মুখটা লাল হয়ে উঠল। কাঁদলো না একটুও। আস্তে আস্তে চলে গেল।
এই তুই বুড়িকে কি করছিস? দাঁড়া… একটু পর মা এল তাড়া করে। হাতে মোটা একটা পাটখড়ি।
দিলাম দৌড়। নৌকাটা কোনো রকম খুলেই ধাক্কা দিয়ে উঠে পড়লাম।
পিছন থেকে মার গলা থামছে না- তুই আজ বাড়ি আয়… তোর একদিন কি আমার একদিন… আজ তোর খাওয়া বন্ধ…
৪.
দুদিন ধরে বুড়ি আর কাছে আসছে না। দুপুর হলেই কেমন যেন একলা একলা লাগে। এদিক ওদিক ঘুরি। মাছ ধরতে বসে পড়ি। কিন্তু স্বস্তি নাই।
ভয়ে ভয়ে ওদের ঘরের কাছে যাই। দরজায় দাঁড়িয়ে আছে। হাত দিয়ে ইশারায় ডাকি। অন্যদিক মুখ ঘুরিয়ে নেয়। আমি তবু দাঁড়িয়ে থাকি। আঁড়চোখে আবার তাকায়। আমি আবার ডাকি। মাথা নাড়ে- না।
দুপুরের ভাত হয়ে গেলে মার গলা শুনি। দেরী করলে মা কৃষাণদের খাবার রেডী করতে ব্যস্ত হয়ে পড়বে। তখন চাইলেও দেবে না। বুড়ির দিকে আরেকবারে তাকিয়ে দৌঁড়ে রান্নাঘরে চলে আসি।
৫.
মাছ ধরতে বসে পড়ছি। বেশ ভালোই আমদানী হচ্ছে। তাই বুড়ি যে কখন কাছে এসে দাঁড়িয়েছে, খেয়ালই হয়নি।
– কয়টা পেয়েছ?
মুখটা ঘুরিয়ে দেখে নিলাম।
– মা’র কাছে নালিশ দিলি কেন?
– আমি দেই নাই।
– তবে মা জানলো কি করে?
উত্তর নাই।
– ফড়িং ধরবি?
ও পাশে থাকলে বসে থাকতে ইচ্ছে করে না। ছোটাছুটি করতেই ভালো লাগে।
মাথা নাড়তেই উঠে পড়লাম। ফড়িং ধরার আয়োজন শুরু হয়ে গেল। কিন্তু দু-চারটে ধরার পর কেমন যেন আর ইচ্ছে করছে না।
– ফড়িং ধরতে আর ভালো লাগছে না?
ওর মুখটা উজ্জ্বল হয়ে উঠলো। বলল- এগুলো ছেড়ে দেবো?
– দে। আমি তখন এত কষ্ট করে বানানো ফাঁদটা কি করব- ভাবছি।
ও এসে আমাকে জড়িয়ে ধরল। আস্তে আস্তে বলল- আমাকে বিয়ে করবা?
স্কুলে আমার অলরেডী একটা পছন্দ আছে। প্রথম প্রেম বলে কথা! সেটা বুড়ি আগেই জানত। তাই এ ঘটনায় হা হয়ে গেলাম। একটু ভেবে বললাম- তুই তাহলে ছোটোবউ হতে পারিস। বুড়ি তাতেই রাজি।
হঠাত পাশের টিউবয়েলের কাছ থেকে গানের আওয়াজ ভেসে এল-
“ছোট্ট কালে গাছ তলাতে
পুতুল খেলার ছলনাতে
আম কুড়াতে যাইতাম দুজনা রে জরিনা
আমি কি তোর আপন ছিলাম না…”
গ্রামে-গঞ্জে মাইকে বাজানো খুব পরিচিত একটা গান।
ঐ সময় আমাদের লজিং মাস্টার খাওয়া শেষে টিউবয়েলে এসেছেন হাত আর থালা ধুতে। বুঝলাম পুরা ঘটনাটাই তার চোখে পড়েছে কেননা তার হাত আর থালা ধোয়া হয়ে গেছে।
গানটা শুনতেই বুড়ি আমাকে ছেড়ে দিল। গান শেষ করে স্যার হাসতে হাসতেই বললেন- আজ টেন্সের পরীক্ষা হবে। না পারলে তোর বিয়ে করা বের হয়ে যাবে…
পরীক্ষার কথা শুনতেই মেজাজ খারাপ হয়ে গেল। সামনে বুড়ি তখনো দাঁড়িয়ে। দিলাম আবার চড়। মাথাটা একটু কাত হয়ে আবার সোজা হয়ে গেল। বাঁ হাতটা শুধু গালে উঠে এল। চলে গেল না আগের মত।
– স্যার ওইখানে, তুই দেখিস নাই?
– নাহ্।
এবার আর কি বলা যায়! কিছুই মাথায় আসছে না। কিছুক্ষণ ওভাবেই দাঁড়িয়ে থাকলাম।
– মাছ ধরবি?
– হুম।
– চল তাহলে। বাঁ হাত দিয়ে ওর ডান হাতটা ধরে হাঁটা শুরু করলাম। তখন শুনলাম ফোঁপাচ্ছে। মাথা ঘুরে তাকাতেই দেখলাম চোখে জল।
– আর কাঁদিস না; আর মারবো না।
৬.
স্কুল ফাইনাল হয়ে গেল। বিকেলে মাঠে গোল্লাছুট খেলছি। খেলার এক ফাঁকে বুড়ি বলল যে ওরা অন্য জায়গায় চলে যাবে। সেখানের স্কুলেই ভর্তি হবে তখন। আরো কি কি যেন বলছিল। খেলার উৎসাহে ভালো করে শুনি নাই।
আজ সকাল থেকেই ওদের বাড়িতে সব বাঁধা হচ্ছে। ওরা চলে যাবে। আমার খুব মন খারাপ। ঘর থেকে বের হচ্ছি না।
দুপুরের দিকে সবার সাথে দেখে করে আমার রুমে এল।
– আমরা আজ চলে যাচ্ছি।
ঠাস করে একটা চড় লাগিয়ে দিলাম। কোনো কথা বলতে পারলাম না।
বুড়িও কিছু বলল না।
ধীরে ধীরে চোখের আড়াল হয়ে গেল।
————————-
২১ সেপ্টেম্বর ২০১০