ওকে পৌঁছে দিয়ে বাসায় আসতেই মা আর ছোটো ভাই ধরল। আমি নাকি বেশি বেশি করছি। তার সাথে এত ঘোরাঘুরির কি আছে? যাওয়ার সময় ট্রেনে উঠিয়ে দিলেই তো হত। নামিয়ে দিয়ে আসার কি দরকার ছিল…হেন তেন… অনেক কষ্টে মাথাটা ঠাণ্ডা রেখে “তার সাথে তো আমার কোনো সম্পর্ক নেই, এত ভাবছ কেন?” উত্তর দিয়ে বাথরুমে ঢুকে গেলাম।
মনটা খারাপ। পরের দিন থেকে আবার কাজ শুরু। আই হেইট মানডে!
সোমবারটা কোনরকম পার করলাম। সপ্তাহের অন্যদিনগুলোও কেটে গেল এসএমএস-এর উপর দিয়ে।
শুক্রবার রাত। পৌনে ১১টার দিকে শুয়ে পড়লাম। ঘুম আসছে না; ফিরে আসছে স্কুল-কলেজের সেই আবেগ যাকে গত এক যুগ ধরে খুঁজে ফিরছি। গাড়িটা নিয়ে বেড়িয়ে পড়লাম।
১৫ মাইল। ট্রাফিক না থাকলে ১৫ থেকে ২০ মিনিটের পথ। প্রথম অভিসারের রাত বলেই কি রাজপথটা আজ শুধু আমার! ১২ মিনিটে পৌঁছে গেলাম। বাসার নিচে গিয়ে এসএমএস দিলাম- বাসার নিচে। পারলে বাইরে এসো, না হলে জানালার কাছে!
নিজের বুকের মধ্যে জেগে ওঠা ঝড় দিয়ে তার বুকের ঝড় মাপতে শুরু করলাম।
– গাড়ি দেখছি। জানালার কাছে গিয়েছিলাম।
– আমি তো তোমাকে দেখতে পেলাম না। কি করবো?
– চলে যান। কেনো এত পাগলামী করছেন? কাকী জানালার কাছে অন্ধকারে বসে ফোনে কথা বলছেন। আমি দেখতে গিয়ে প্রায় তার গায়ের উপর পড়ে গিয়েছিলাম। তাই চলে আসছি। প্লীজ এত পাগলামি করো না।
বুঝলাম ঝড় সব উড়িয়ে নিয়ে গেছে। ঝড়ের ঝাপটায় আপনি থেকে তুমিতে নেমে এসেছে। পরে বলেছিল যে আমি গিয়েছিলাম বলে খুব আনন্দ হচ্ছিল, কেউ দেখে ফেলে কিনা ভেবে খুব ভয় আর এত আয়োজন করেও ভালো করে দেখা হলো না ভেবে খুব কষ্ট। এই আনন্দ ভয় আর কষ্টের মিলিত আবেগে তুমি করে বলে ফেলেছে!
তুমি করে বলেছে- এই আনন্দটুকু নিয়েই ফিরে এলাম! রাতে আর ঘুম হলো না। শুধু স্বপ্ন আর স্বপ্ন…
পরেরদিন দেখি আবার আপনি করে শুরু! মনটা একটু দমে গেল। জিজ্ঞেস করল নচিকেতার এই গানটা শুনেছি কিনা-
“যদি হঠাৎ আবার দেখা হয় দুজনার-
কোন পথের বাঁকে, বহু কাজের ফাঁকে,
শুধু জানতে চাইবো আজও মনে আছে কি
মনে আছে কি স্মৃতি, নাকি দিয়েছে ফাঁকি
সেই চেনা সুর যা গাইতাম একই সাথে-
চালো সাজনা যাহাতাক ঘাটা চালে…”
বুঝে ফেললাম- ঝড়ে একটু কমলেও একেবারে থামেনি। নীতিকথা আর শাসনের বেড়াজাল ভেঙে এগোতে সাহস পাচ্ছে না। কে কি বলবে সেই ভয়তেই আবেগটা দমিয়ে রাখছে শুধু।
মনের মধ্যে নচিকেতা বেজে চলছে। আবেগের পারদ উর্ধ্বগামী। ঐ এক সপ্তাহে আমার সাথে চারদিন ঘুরে বেড়ালো, সারাদিন বাসায় বসে সেসব ভাবলাম আর লিখে ফেললাম-
আর যদি না শুনি গান
একই কথা একই সুরে
ভালোবাসা কি মরে যাবে
আর যদি না আঁকে দাগ
মনের পাতায় রঙ-তুলিতে
ভালোবাসা কি মরে যাবে
আর যদি না হাসে প্রাণ
তোমার গল্প শুনে অবিরাম
পার্কের ঐ ঘাসগুলোতে
তোমার কোলে মাথা রেখে
সুখের বাতাস না যায় বয়ে
ভালোবাসা কি মরে যাবে
আর যদি না দেখে চোখ
রক্তভেজা ঐ দুটি ঠোঁট
গভীর কালো চোখের ভিতর
আমার চোখের ছায়া পড়ে
না হারাই আর অবাক দেশে
ভালোবাসা কি মরে যাবে
আর যদি না ভাবে মন
তোমার কথা কারণ-অকারণ
ভাবনার পাল তুলে নায়
স্বপ্নের দেশে কভু না হারায়
কল্পনায় আর রাত জেগে
ভালোবাসা কি মরে যাবে
আর যদি না খোঁজে হাত
গভীর হলে আঁধার রাত
যদি আর না হয় বলা
সুখ-দুঃখের গল্প কথা
বিছানাটা খালি পড়ে রবে
ভালোবাসা কি মরে যাবে
আর যদি না হয় দেখা
বৃষ্টি ভেজা বিকেলবেলা
নদীর ধারের বেঞ্চিটাতে
তোমার আমার বসে থাকা
পদ্ম কোমল হাতটি ধরে
ভালোবাসা কি মরে যাবে
আর যদি না হয় হাঁটা
পার্কের ঐ পথটি ধরে
ক্লান্তি আর অলসতায়
পথের ধারে বসে পড়া
রাঙা চরণ কোলে করে
ভালোবাসা কি মরে যাবে
আর যদি না হয় বসা
লেকের পাড়ের পাথরটাতে
চন্দ্রটা ঠিক উঠবে হেসে
তোমার কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে
তুমি-আমি না রইলেও
ভালোবাসা কি মরে যাবে
আর যদি না হয় খেলা
তাস নিয়ে ছলাকলা
জিতে গেলে তোমার মুখে
চাঁদের আলো চুঁইয়ে পড়ে
আঁধার নামবে মনের বনে
ভালোবাসা কি মরে যাবে
আর যদি না হয় চলা
পিচঢালা ঐ পথটি বেয়ে
চোখে ছলছল জলের খেলা
তোমার আমার বিদায় বেলা
গাড়ির গতি থেমে যাবে
ভালোবাসা কি মরে যাবে
বাসায় নামিয়ে দিয়ে কিছুক্ষণ ছিলাম। আসার সময় দেখলাম চোখ টলমল করছে, শরীরটা একটু একটু করে কাঁপছে। পরে জিজ্ঞেস করাতে বলেছিল- চোখে চশমা ছিলো তো তাই বেশী দেখছেন!
ঐ বেশী দেখাই কাল হল আমার জন্য!
লেখাটা দিয়েছিলাম। পরে দেখবে বলে রেখে দিল। মন্তব্য জানায়নি ওটার ব্যাপারে।
কিছুদিন পরে সুযোগ হলো কথা বলার। খুলে বললাম সব মনের কথা। প্রেমের গুরু থেকে শুরু করে তুমি আমার সব।
ওর চোখে আবার জলের খেলা। বলল, সব না।
– সব না কেন?
এবার অন্যদিকে তাকিয়ে ধরা গলায় ধীরে ধীরে বলল, আপনার সাথে আমার সব সম্পর্ক আছে শুধু বউ আর প্রেমিকা বাদে!
———————-
১৬ সেপ্টেম্বর ২০১০